চট্টগ্রাম টেস্ট তৃতীয় দিনেই জিতলো বাংলাদেশ

বাংলারচিঠি ডটকম ডেস্ক॥
বোলারদের নৈপুণ্যে ম্যাচের তৃতীয় দিনেই চট্টগ্রাম টেস্ট জিতল বাংলাদেশ। জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২০৪ রানের টার্গেট দিয়ে বোলারদের নৈপুণ্যে ৬৪ রানে পায় টাইগাররা। দু’দিন বাকী থাকতেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে জয় পাওয়ার পাশাপাশি নিজ মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়ের স্বাদও পেল বাংলাদেশ। এই জয়ে দুই ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। ২০৪ রানের টার্গেটে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩৯ রানে অলআউট হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় দিনের মত তৃতীয় দিনও চট্টগ্রামের পিচে রাজত্ব করেছে স্পিনাররা। গতকাল ১৭ উইকেট পতনের পর আজ ১৫ উইকেট শিকার করেছে দু’দলের বোলাররা।

প্রথম ইনিংসে ৭৮ রানের লিড পেয়েও অস্বস্তি নিয়ে দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ করে বাংলাদেশ। কারণ ৫৫ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে টাইগাররা। তারপরও ৫ উইকেট হাতে নিয়ে ১৩৩ রানে এগিয়ে ছিলো বাংলাদেশ। দিন শেষে ক্রিজে ছিলেন মুশফিকুর রহিম ও মেহেদি হাসান মিরাজ। মুশফিক ১১ ও মিরাজ শূন্য রানে অপরাজিত ছিলেন।

২৪ নভেম্বর দিনের প্রথম সাফল্য পেতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ১৯ রান করা মুশফিককে বোল্ড করেন বাংলাদেশের ষষ্ঠ উইকেটের পতন ঘটান ডান-হাতি পেসার শ্যানন গাব্রিয়েল।

এরপর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে দলের রানা চাকা সচল করার চেষ্টা করেন মিরাজ। দু’জনের ব্যাটিং দৃঢ়তায় বাংলাদেশের স্কোর বড় হচ্ছিলো। ফলে দলীয় স্কোর শতরানের স্বাদ নেয়। কিন্তু দলীয় স্কোর তিন অংকে পা দেয়ার কিছুক্ষণ পর প্যাভিলিয়নের পথে হাটতে হয় মিরাজকে। ১৮ রান করা মিরাজকে তুলে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ব্রেকথ্রু এনে দেন লেগ-স্পিনার দেবেন্দ্র বিশু।

মিরাজকে হারিয়ে দমে যাননি মাহমুদুল্লাহ। প্রথম ইনিংসে ২৬ রান করা অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা নাইম হাসানকে নিয়ে লড়াই শুরু করেন মাহমুদুল্লাহ। মিরাজের সাথে ৩৭ রানের জুটির পর নাইমকে নিয়েও ভাল স্কোর করার পথে হাটতে থাকেন রিয়াদ।

নাইম-মাহমুদুল্লাহ ক্রিজে ৬ ওভার কাটিয়েও দেন। এ সময় তারা যোগ করেন ১৬ রান। এর পরই আবারো বাংলাদেশ শিবিরে আঘাত হানেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশু। ৫ রান করা নাইম শিকার হন বিশুর।

নাইমকে বিদায় দেওয়ার ওভারেই মাহমুদুল্লাহকেও নিজের শিকার বানান বিশু। ১টি করে চার ও ছক্কায় ৪৬ বলে ৩১ রান করেন মাহমুদুল্লাহ। পরের ওভারেই বাংলাদেশের শেষ উইকেট হিসেবে তাইজুলকে তুলে নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেজ। ফলে ১২৫ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশু ৪টি, চেজ ৩টি, ওয়ারিকান ২টি ও গ্যাব্রিয়েল ১টি উইকেট নেন।

মধ্যাহ্ন-বিরতির আগে বাংলাদেশ গুটিয়ে যাওয়ায় ম্যাচ জয়ের জন্য ২০৪ রানের টার্গেট পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যাট হাতে নেমেই সাকিব ও তাইজুলের ঘুর্ণিতে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফলে ১১ রানের মধ্যে ক্যারিবিয়দের চার ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে ফিরতে বাধ্য হন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব। ওপেনার কাইরেন পাওয়েলকে শুন্য হাতে ফিরিয়ে দেন তিনি। এই উইকেটের মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ২শ উইকেট শিকার করেন সাকিব। সেই সাথে দ্রুত ৩ হাজার রান ও ২শ উইকেট শিকারের বিশ্বরেকর্ডও গড়েন সাকিব।

বিশ্বরেকর্ডের পরপরই প্রতিপক্ষ শিবিরে দ্বিতীয় আঘাতও হানেন সাকিব। তিন নম্বরে নামা শাই হোপকে ৩ রানে থামিয়ে দেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।

অধিনায়কের জোড়া আঘাত দেখে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেননি চলতি বছর বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করা তাইজুল। অন্যপ্রান্ত দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাফেটকে ৮ ও চার নম্বরে নামা রোস্টন চেজকে শুন্য রানে ফিরিয়ে দেন তাইজুল। ফলে ১১ রানে চতুর্থ উইকেট হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই পরিস্থিতি নিয়ে তৃতীয় দিনের মধ্যাহ্ন-বিরতিতে যায় ক্যারিবীয়রা।

বিরতি শেষে হার্ড-হিটার শিমরোন হেটমায়ারকে নিয়ে দ্বিতীয় সেশনের খেলা শুরু করেন সুনীল অ্যামব্রিস। উইকেটে গিয়েই মারমুখী মেজাজ ধারন করেন হেটমায়ার। সাকিবের করা সপ্তম ওভার থেকে দু’টি চার ও ১টি ছক্কায় ১৭ রান নেন তিনি।

ধীরে ধীরে আরও ভয়ংকর ও বড় ইনিংস খেলার আভাস দিচ্ছিলেন হেটমায়ার। কিন্তু ১৯ বলে ২৭ রান করে থামতে হয় তাকে। মিরাজের বলে ছক্কা মারতে গিয়ে মিড-অফে ক্যাচ দেন হেটমায়ার। তার ইনিংসে ৩টি চার ও ১টি ছক্কা ছিলো।

হেটমায়ার যখন ফিরেন তখন দলের স্কোর ৫ উইকেটে ৪৪ রান। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোয়ার-অর্ডারের আরও তিন ব্যাটসম্যানকে নিজের শিকার বানান তাইজুল। এতে দ্রুতই ম্যাচ শেষ হয়ে যাবার পথ তৈরি হয়ে যায়। কারন ৭৫ রানে অষ্টম উইকেট হারিয়ে বসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিন উইকেট নিয়ে এই ইনিংসে নিজের শিকার সংখ্যা পাঁচ’এ নিয়ে যান তাইজুল। এই নিয়ে সপ্তমবারের মত ও চলতি বছর চতুর্থবারের মত এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিলেন তাইজুল।

তবে অষ্টম উইকেট পতনের পর বাংলাদেশের বোলারদের সামনে নিজেদের প্রতিরোধ গড়ে তুলেন অ্যামব্রিস ও দশ নম্বর ব্যাটসম্যান জোমেল ওয়ারিকান। বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তোলার কাজটি করছিলেন তারা। উইকেটে সেট হয়ে কিছুটা সর্তক হয়ে যান অ্যামব্রিস ও ওয়ারিকান। উইকেট বাঁচিয়ে খেলে লড়তে থাকেন তারা। সেই সাথে দলের স্কোরটাও বাড়াতে থাকেন এই দুই ব্যাটসম্যান। ফলে চিন্তার ভাঁজ ভর করে বাংলাদেশের কপালে।

অবশেষে ৩৫তম ওভারে বাংলাদেশকে চিন্তামুক্ত করেন মিরাজ। ওয়ারিকানকে থামিয়ে দেন তিনি। নবম উইকেটে ৬৩ রান যোগ করেন অ্যামব্রিস ও ওয়ারিকান। ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় ৫৫ বলে ৪১ রান করেন ওয়ারিকান।

ওয়ারিকান ফিরে যাবার তিন বল পরই নিজেদের শেষ উইকেট হারিয়ে ১৩৯ রানেই গুটিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস। অ্যামব্রিসকে শিকার করে ক্যারিবীয়দের ইনিংসের ইতি টানেন বাংলাদেশের তাইজুল। ইনিংসে ৩৩ রানে ৬ উইকেট নিয়েছেন তিনি। ৬২ বলে ৪৩ রান করেন অ্যামব্রিস। প্রথম ইনিংসে ১২০ রান করে ম্যাচ সেরা হয়েছেন বাংলাদেশের মোমিনুল।

৩০ নভেম্বর থেকে ঢাকায় শুরু হবে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট।

স্কোর কার্ড :
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস : ৩২৪/১০, ৯২.৪ ওভার (মোমিনুল হক ১২০, ইমরুল কায়েস ৪৪, ওয়ারিকান ৪/৬২)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস : ২৪৬/১০, ৬৪ ওভার (হেটমায়ার ৬৩, ডওরিচ ৬৩*, নাইম ৫/৬১)।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস : (আগের দিন ৫৫/৫, ১৭ ওভার, মুশফিক ১১*, মিরাজ ০*)
ইমরুল কায়েস বোল্ড ব ওয়ারিকান ২
সৌম্য সরকার ক ব্রাফেট ব চেজ ১১
মোমিনুল হক এলবিডব্লুব ব চেজ ১২
মোহাম্মদ মিথুন বোল্ড ব বিশু ১৭
সাকিব আল হাসান ক গাব্রিয়েল ব ওয়ারিকান ১
মুশফিকুর রহিম বোল্ড ব গাব্রিয়েল ১৯
মেহেদি হাসান মিরাজ ক ডাউরিচ ব বিশু ১৮
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ক হোপ ব বিশু ৩১
নাইম হাসান ক হোপ ব বিশু ৫
তাইজুল ইসলাম ক ওয়ারিকান ব চেজ ১
মুস্তাফিজুর রহমান অপরাজিত ২
অতিরিক্ত (বা-২, লে বা-১, নো-৩) ৬
মোট (অলআউট উইকেট, ৩৫.৫ ওভার) ১২৫
উইকেট পতন : ১/১৩ (ইমরুল), ২/১৩ (সৌম্য), ৩/৩২ (মোমিনুল), ৪/৩৫ (সাকিব), ৫/৫৩ (মিথুন), ৬/৬৯ (মুশফিক), ৭/১০৬ (মিরাজ), ৮/১২২ (নাইম), ৯/১২৩ (মাহমুদুল্লাহ), ১০/১২৫ (তাইজুল)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলিং :
কেমার রোচ : ১-০-১১-০,
জোমেল ওয়ারিকান : ১৬-২-৪৩-২,
রোস্টন চেজ : ৬.৫-১-১৮-৩,
দেবেন্দ্র বিশু : ৯-০-২৬-৪,
শ্যানন গাব্রিয়েল : ৩-০-২৪-১ (নো-৩)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস :
ক্রেইগ ব্রাফেট এলবিডব্লু ব তাইজুল ৮
কাইরেন পাওয়েল স্টাম্পড মুশফিক ব সাকিব ০
শাই হোপ ক মুশফিক ব সাকিব ৩
সুনীল অ্যামব্রিস ক মুশফিক ব তাইজুল ৪৩
রোস্টন চেজ এলবিডব্লু ব তাইজুল ০
শিমরোন হেটমায়ার ক নাইম ব মিরাজ ২৭
শেন ডাউরিচ এলবিডব্লু ব তাইজুল ৫
দেবেন্দ্র বিশু বোল্ড ব তাইজুল ২
কেমার রোচ এলবিডব্লু ব তাইজুল ১
জোমেল ওয়ারিকান ক সাকিব ব মিরাজ ৪১
শ্যানন গাব্রিয়েল অপরাজিত ০
অতিরিক্ত (বা-৯) ৯
মোট (অলআউট, ৩৫.২ ওভার) ১৩৯
উইকেট পতন : ১/৫ (পাওয়েল), ২/১১ (হোপ), ৩/১১ (ব্রাফেট), ৪/১১ (চেজ), ৫/৪৪ (হেটমায়ার), ৬/৫১ (ডাউরিচ), ৭/৬৯ (বিশু), ৮/৭৫ (রোচ), ৯/১৩৮ (ওয়ারিকান), ১০/১৩৯ (অ্যামব্রিস)।
বাংলাদেশ বোলিং :
সাকিব আল হাসান : ৭-০-৩০-২,
নাইম হাসান : ৭-১-২৯-০,
তাইজুল ইসলাম : ১১.২-২-৩৩-৬,
মেহেদি হাসান মিরাজ : ৮-১-২৭-২,
মুস্তাফিজুর রহমান : ২-০-১১-০।
ফল : বাংলাদেশ ৬৪ রানে জয়ী।
সিরিজ : দুই ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
ম্যাচ সেরা : মোমিনুল হক (বাংলাদেশ)।
সূত্র : বাসস