নিজস্ব প্রতিবেদক, জামালপুর ॥
‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’- এমন পরিস্থিতি জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের দক্ষিণ মালিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। বিদ্যালয়টির হাজিরা খাতায় রয়েছে ১১৩ জন শিক্ষার্থী। উপবৃত্তির টাকাও যাচ্ছে মায়েদের মোবাইল ফোনে। মাঝে মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচজন শিক্ষার্থী হাজির হলেও বাকিরা থাকে অনুপস্থিত। কোনো কোনো দিন একজন শিক্ষার্থীও হাজির থাকে না।
জানা গেছে, বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ২০০০ সালে। জাতীয়করণ হয় ২০১৩ সালে। এরপর থেকে বিদ্যালয়টি বেশ ভালোভাবেই চলছিল। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে থাকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৩ জন। অভিযোগ রয়েছে, তাদের শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশি বিদ্যালয়ে আসে না গত সাত মাস ধরে। কিন্তু হাজিরা খাতায় তাদেরকে নিয়মিত হাজির দেখানো হচ্ছে। বছরের শুরুতেই তারা নতুন বই নিয়েছে এবং প্রত্যেকেই উপবৃত্তির তালিকাভুক্ত। আর চারজন শিক্ষিকা বেতনও পাচ্ছেন নিয়মিত। জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসাররাও বিদ্যালয়টির এরকম নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিদ্যালয়টি বর্তমানে বন্ধ হওয়ার পথে।
গত ২১ জুলাই ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে চতুর্থ শ্রেণির কক্ষে মাত্র তিনজন ছাত্রী পাওয়া গেছে। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী লিজা আক্তার বললো, ‘ছাত্র-ছাত্রীরা আসে না বলে আমাদের ভালো লাগে না। অনেক বলি তাও তারা আসে না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা অভিযোগ করে জানান, বিদ্যালয়টিতে আগে ভালো পড়ালেখা হতো। ২০১৭ সাল থেকে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকরা অনিয়মিত হতে শুরু করেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই বিদ্যালয়টি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকাসহ চারজন শিক্ষিকার মধ্যে তিনজনকে পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। ফলে একজন শিক্ষিকার পক্ষে পাঠদানসহ বিদ্যালয় পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই অভিভাকরা তাদের ছেলেমেয়েদের স্থানীয় চারটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে সরিয়ে নিয়েছেন। উপবৃত্তির টাকা প্রসঙ্গে অভিভাবকরা জানিয়েছেন, সামান্য উপবৃত্তির টাকার আশায় ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চান না তারা। উপবৃত্তির টাকা ফেরৎ নিলেও তাদের কোনো আপত্তি নেই।
জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাশের উত্তর মালিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলামকে প্রেষণে দক্ষিণ মালিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদে বদলি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি এসেই দেখছি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসে না। অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি তাদের ছেলেমেয়েরা পাশের চারটি কিন্ডার গার্টেনে পড়াশোনা করছে। তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারছি না। গত ৯ জুলাই উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান এসে মা সমাবেশ করেছেন। তাতে ৫৫ জন অভিভাবক উপস্থিত ছিলেন। মা সমাবেশের পরও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে না তারা। তিনজন শিক্ষিকা পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণে গেছেন। বর্তমানে দু’জন শিক্ষক খুবই চাপে এবং বিব্রতকর অবস্থায় আছি।’
বিদ্যালয় টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন হাজিরা খাতায় হাজির দেখানো হয় এ অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি নিরব থাকেন।
বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সেলিম রেজা তরফদার শিক্ষার্থী সঙ্কট প্রসঙ্গে বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা কেন্দ্র দূরে হওয়ায় এবং কেন্দ্র বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় অবৈধ সুযোগ দেওয়ায় গত দুই বছর ধরেই অভিভাবকরা চতুর্থ শ্রেণি থেকেই তাদের সন্তানদের এই বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে নেয়। একই সাথে প্রথম শ্রেণিতেও ভর্তি করতে চায় না। চলতি বছর তিনজন শিক্ষিকা এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণে যাওয়ায় বিদ্যালয়টি একেবারেই খালি হয়ে গেছে।’
১১৩ জন শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জানুয়ারি মাসে তালিকা করা হয়। বছরের প্রতি ছয়মাসের প্রথম কিস্তির উপবৃত্তির টাকা তাদের মায়েদের মোবাইল ফোনে গেছে। বিদ্যালয়ে না এলে তাদের কাছে আর যাতে উপবৃত্তির টাকা না যায় তার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিবো।’
সরিষাবাড়ী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল হালিম বাংলার চিঠি ডটকমকে বলেন, ‘বিদ্যালয়টির এরকম নাজুক পরিস্থিতি চলছে তা আমি না জেনে বলতে পারছি না। ওই বিদ্যালয় পরিদর্শন করে তারপর বলতে পারবো।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. শহিদুল ইসলামেরও বিদ্যালয়টি সম্পর্কে ধারণা নেই। তিনি বাংলার চিঠি ডটকমকে বলেন, ‘ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা গণহারে অনুপস্থিত থাকায় বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে তা উপজেলা থেকে আমাকে জানানো হয়নি। ওই বিদ্যালয় পরিদর্শন করে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।’ বিদ্যালয়ে না এসেও যদি শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির টাকা পেয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার এবং উপবৃত্তি বন্ধ করার বিধানও রয়েছে বলে তিনি জানান।