জামালপুরে গৃহবধূকে গণধর্ষণ ও স্বামীকে হত্যার অভিযোগে মামলা, গ্রেপ্তার ১

গণধর্ষণ ও পিটুনিতে গুরুতর আহত গৃহবধূ। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

জামালপুরে একজন গৃহবধূকে গণধর্ষণ ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করে স্বামীকেও হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যার প্রচারণা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই গৃহবধূকে ধর্ষণ ও তার স্বামীকে হত্যাকারী প্রতিবেশী তিন যুবকসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের আরো দুজনকে আসামি করে ১৮ নভেম্বর রাতে জামালপুর সদর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। ঘটনার তিনদিন পর গৃহবধূর দায়ের করা মামলার আসামিদের মধ্যে মো. শাওন নামের একজন আসামিকে রাতেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গণধর্ষণ ও পিটুনিতে গুরুতর অসুস্থ ওই গৃহবধূকে জামালপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ১৫ নভেম্বর রাতে জামালপুর সদর উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামে এ পাশবিক ঘটনা ঘটে।

গ্রেপ্তার আসামি মো. শাওন (৩০) রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে। এজাহারভুক্ত অন্য দুজন আসামি হলেন একই গ্রামের মো. ময়েন উদ্দিনের ছেলে মো. ছানোয়ার হোসেন ছানু (৪০) ও মো. ওমর আলীর ছেলে মো. রফিজ উদ্দিন (৩৫)।

মামলাটির বাদী ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ওই গৃহবধূর বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের সুরেন টাল গ্রামে। তার বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। ১৪ বছর আগে তার বিয়ে হয় জামালপুর সদর উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের কাঠমিস্ত্রি মো. খলিলুর রহমানের (৩৫) সাথে। তাদের কোনো সন্তান নেই। বিয়ের পর থেকেই তিনি রামকৃষ্ণপুর গ্রামে স্বামীর বাড়িতেই বসবাস করে আসছেন।

১৫ নভেম্বর রাতে গৃহবধূর স্বামী ও শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন না। এ সুযোগে রাত ৮টার দিকে প্রতিবেশী তিন যুবক ছানোয়ার হোসেন ছানু, মো. শাওন ও রফিজ উদ্দিন তাকে বাড়ি থেকে তুলে বাড়ির পেছনে জঙ্গলে বাঁশঝাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে তিনজনে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। এ সময় তাদের সহযোগী অজ্ঞাত পরিচয়ের আরো দুজন যুবক পাহারা দেন। ধর্ষণের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ছানোয়ারের বাড়িতে। ধর্ষণের শিকার হয়েও ওই গৃহবধূ পার পাননি। তাকে বাঁশঝাড়ের নিচ থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তুলে নিয়ে ঘটনার মূল হোতা ছানোয়ারের বাড়ির ওঠানে আমগাছের সাথে বেঁধে রাখে। তারা একাশি গাছের কাঁচা ডাল দিয়ে বেদম পেটায় তাকে। পিটুনিতে তার হাতের দুই বাহু, পিঠ এবং পায়ের রানের দিকে মারাত্মক ফোলা জখম হয়। এতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। একই সময়ে ছানোয়ার গৃহবধূকে জানায় এ ঘটনা শুনে তার স্বামী খলিলুর রহমান নাকি বাড়ির পূর্ব পাশে কাঁঠাল গাছে রশি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তখন রাত প্রায় ১১টা বাজে। তখন তারা গাছের সাথে বাঁধন খুলে দেয় এবং ছানোয়ারের ঘরের একটি কক্ষে আটকে রাখে গৃহবধূকে।

অভিযোগে আরো জানা গেছে, নির্যাতনকারীরা রাতেই তার স্বামীর আত্মহত্যার কথা প্রচার করে দেয় এলাকায়। জানাজানি হলে প্রতিবেশীরা ছুটে যায় ওই বাড়িতে। কিন্তু কেউ মরদেহ কাঁঠাল গাছ থেকে নামাতে সাহস পাননি। প্রতিবেশীরা ঘটনাটি জামালপুর সদর থানায় জানালে ঘটনার পরের দিন ১৬ নভেম্বর সকালে উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. গোলজার আলম ওই বাড়িতে যান। পুলিশের উপস্থিতিতেই কাঁঠাল গাছ থেকে খলিলুর রহমানের মরদেহ নামানো হয়। একই সাথে পুলিশ নির্যাতন ও ধর্ষণকারী দলের মূল হোতা ছানোয়ারের বাড়ি থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গৃহবধূকে উদ্ধার করেন। এ সময় গৃহবধূ কান্নায় ভেঙে পড়ে তাকে ধর্ষণের বর্ণনা দেন এবং গাছের ডাল দিয়ে বেদম পিটুনিতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোলা জখমগুলো এসআই মো. গোলজার আলমকে দেখান। কিন্তু এসআই গোলজার আলম আগে মরদেহ মর্গে নেওয়ার কথা বলে বিষয়টি পরে দেখবেন বলে গৃহবধূকে বোঝান। একপর্যায়ে পুলিশ শত শত মানুষের উপস্থিতিতে মরদেহের সুরতহাল করে মরদেহটি জামালপুর সদর হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায়। পুলিশ গৃহবধূ ও তার শ্বশুর ইমান আলীকেও মরদেহের সাথে করে নিয়ে যায়। ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে তারা মরদেহ রামকৃষ্ণপুর গ্রামে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ এ ঘটনায় কোনো মামলা না নিয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন।

এ ঘটনার বিচার চাইতে ওই গৃহবধূ তার শ্বশুর ইমান আলীসহ কয়েকজনকে সাথে নিয়ে ১৭ নভেম্বর সকালেও সদর থানায় গিয়েছিলেন অভিযোগ করতে। তাদেরকে সারাদিন বসিয়ে রেখে বিদায় করে দেওয়া হয়। এরপর তারা ১৮ নভেম্বর রাত নয়টার দিকে গৃহবধূ তার শ্বশুর ও এলাকার কয়েকজন লোক নিয়ে জামালপুর প্রেসক্লাবে যান। গৃহবধূ সাংবাদিকদের কাছে তার স্বামীকে হত্যা এবং তাকে নির্মম নির্যাতনের ঘটনার বিস্তারিত খুলে বলেন। সাংবাদিকদের সহায়তায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে জামালপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতেই গৃহবধূ বাদী হয়ে তাকে গণধর্ষণ এবং তার স্বামীকে হত্যার অভিযোগ এনে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।

ওই গৃহবধূ বাংলারচিঠিডটকমকে বলেন, ‘প্রতিবেশী ছানোয়ার ও তার সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। আমি রাজি হই না। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) রাতে আমাকে তুলে নিয়ে আমার সাথে খারাপ কাজ করার সময় মেলা হাতে পায়ে ধরছি। আকুতি করছি। রেহাই পাই নাই। অরা আমারে ছানোয়ারের বাড়িত নিয়া আম গাছের সঙ্গে বাইন্ধা গাছের ডাল দিয়া মারতে মারতে দেহেন কি অবস্থা করছে। মারার সময় কয় এই ঘটনা জাইনা তর স্বামী আত্মহত্যা করছে। পরে আমারে বান্ধন খুইলা ছানোয়ারের ঘরে আটকাইয়া রাখে। সারা রাইত আটকাইয়া রাখে। পরের দিন পুলিশ আমার স্বামীর লাশ নামায়। পুলিশ আমারেও ছানোয়ারের ঘর থেইকা বাইর কইরা নিয়া আসে। আমি পুলিশকে মাইরের ফোলা জখম দেখাই। আমার সাথে অরা খারাপ কাজ করছে তাও কই। কিন্তু পুলিশ কিছুই করলো না। অরাই আমার স্বামীরে মাইরা গাছে ঝুলাইয়া রাখছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।’

জামালপুর সদর হাসপাতালের আরএমও চিকিৎসক কে এম শফিকুজ্জামান বাংলারচিঠিডটকমকে জানান, আজ মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) সকালে হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ফাখরিয়া আলমসহ তিন সদস্যের একটি মেডিকেল টিম ধর্ষণ ও পিটুনিতে গুরুতর আহত গৃহবধূর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন। দুয়েক দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। ওই গৃহবধূকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর দায়ের করা মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা জামালপুর সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রাশেদুল ইসলাম বাংলারচিঠিডটকমকে বলেন, ‘গৃহবধূর স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবারের কেউ তখন অভিযোগ না করায় ময়নাতদন্ত করে মরদেহ বুঝিয়ে দিয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ১৮ নভেম্বর রাতে গৃহবধূ তার স্বামীকে হত্যা এবং তাকে ধর্ষণের অভিযোগ করার সাথে সাথেই আমরা মামলা নিয়েছি। মামলাটির দুই নম্বর আসামি মো. শাওনকে ১৮ নভেম্বর রাতে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে আদালতে হাজির করে তিনদিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। মামলাটির অন্যান্য আসামিরা গা ঢাকা দিয়েছে। ধর্ষণের শিকার ওই গৃহবধূর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ঘটনা তদন্তে একজন এএসপি, সদর থানার ওসি এবং র‌্যাবসহ অন্তত ৫০ জন পুলিশ ১৯ নভেম্বর ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং তদন্ত করে দেখছেন।’

জামালপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ছালেমুজ্জামান বাংলারচিঠিডটকমকে বলেন, ‘গৃহবধূর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে জানা যাবে।’ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধারকারী এসআই গোলজার আলম প্রথমদিনই গৃহবধূর অভিযোগ গুরুত্ব না দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি তিনি দায়িত্বে অবহেলা করার মতো কিছু করে থাকেন তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গৃহবধূর দায়ের করা মামলাটি খুব গুরুত্ব সহকারে তদন্তসহ বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’