প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের বিদায়

:সৈয়দ ফারুক হোসেন :
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার আর নেই। চলে গেলেন অনিমেষ, মাধবীলতার স্রষ্টা। না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। বেশ কিছুদিন ধরেই সিওপিডির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৮ মে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৪৫ নাগাদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। খ্যাতনামা এই কথাসাহিত্যিকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসাধীন ছিলেন দক্ষিণ কলকাতার একটি হাসপাতালে। স্ট্রোক’ ও ‘বালবার প্যালসি’ থেকে শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া তাঁর বহুদিন ধরেই সিওপিডি, অবস্ট্রাকটিভ স্প্রি অ্যাপনিয়া ও মায়াসথেনিয়া গ্র্যাভিসেরও সমস্যা ছিল। ওই হাসপাতালে তিনি গত ২৫ এপ্রিল ভর্তি হয়েছিলেন।

বাংলা ভাষার অগ্রগণ্য ও জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সমরেশ বসুদের পরবর্তী সময়ের লেখক সমরেশ মজুমদারের প্রথম গল্প ‘দৌড়’ ১৯৭৫ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর পরের দশকে সমরেশ মজুমদার একের পর এক স্মরণীয় ছোটগল্প, বড় গল্প, উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাতকাহন, তেরো পার্বণ, উনিশ-বিশ, টাকা পয়সা, গর্ভধারিণী, অর্জুন মেজরের অ্যাডভেঞ্চার, এই আমি রেণু, অবশ, স্মরণাগত, দিন যায় রাত যায়, ফেরারি, তীর্থযাত্রী, বন্দি নিবাস, বুনো হাঁস, নিকট কথা, শ্রদ্ধাঞ্জলি, অনুপ্রবেশ, ওরা এবং ওদের মায়েরা, দাউ দাউ আগুন, হারামির হাতবাক্স, বিলে পালায়নি প্রমুখ। ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ ও ‘উত্তরাধিকারে’র ট্রিলজি অথবা দৌড়, গর্ভধারিণীর মতো উপন্যাস তাঁকে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছিল।

১৯৪২ সালের ১০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জিলা স্কুল থেকে। জলপাইগুড়ি জিলা স্কুল থেকে শিক্ষা শেষ করে তিনি কলকাতায় আসেন ১৯৬০ সালে। বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্য মাত্রা’ লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসাবে, আর সেখান থেকেই তার লেখকজীবনের শুরু। সেই লেখাটি ছাপা হয়েছিল দেশ পত্রিকায়, ১৯৬৭ সালে।

সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিলো ওই একই পত্রিকায়, ১৯৭৫ সালে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে বাংলা সাহিত্যের পাঠক তাঁকে সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছেন উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষের ট্রিলজির জন্য। ডুয়ার্সের চা বাগানকে সমরেশ মজুমদারের লেখার সূত্রেই চিনেছিলেন বহু পাঠক। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন।

সমরেশ মজুমদারের বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদারের বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।

তাঁর শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গায়েরকাটা চা বাগানে। ডুয়ার্সের জল-জঙ্গল ও চা-বাগানের জীবন তাঁর বহু গল্প ও উপন্যাসে উঠে এসেছে। ১৯৮২ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং বঙ্কিম পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নকশাল আমলের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘কালবেলা’র চরিত্র অনিমেষ ও মাধবীলতা সমরেশ মজুমদারের অনন্য এক সৃষ্টি বলেই গণ্য করা হয়, যা অসংখ্য পাঠকের ভালবাসা ও সমাদর পেয়েছে। তাঁর শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের চা–বাগানে। স্কুলজীবন কেটেছে জলপাইগুড়িতে। ষাটের দশকের শুরুর দিকে কলকাতায় এসে স্কটিশ চার্চ কলেজে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।

সমরেশ মজুমদারের লেখালেখির শুরু গ্রুপ থিয়েটার ও নাটক লেখার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। তবে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে বেড়ে ওঠা সমরেশকে সম্ভবত বাঙালি পাঠক বেশি মনে রাখবে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ এর জন্য। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের একেবারে গোড়ার দিকে লেখা এই তিন উপন্যাস তাঁকে রাতারাতি পশ্চিমবঙ্গের একজন তারকা লেখকে পরিণত করে। পরবর্তী সময়ে এর চতুর্থ পর্ব ‘মৌষলকাল’ লেখেন সমরেশ। তাঁর জন্মের সময় পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যার ছাপ খানিক পড়েছিল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলেও। এই উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সেই কেটেছে সমরেশ মজুমদারের ছাত্রজীবন। তার গল্পে, উপন্যাসে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে উত্তরবঙ্গের অনন্য সৌন্দর্য। বিপ্লব, সংগ্রাম ও জীবনকে অন্যভাবে যাপনের কাহিনী কখনও তিনি ছেড়ে যাননি। তার ‘গর্ভধারিনী’ উপন্যাস কার্যত বৈপ্লবিক। সমাজতন্ত্র, সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হিমালয়ের কোলে, সান্দাকফু পেরিয়ে এক বরফঢাকা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন তার উপন্যাসের তরুণ চরিত্রদের।

গোয়েন্দা-গল্পেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর লেখা অর্জুনের গল্পে বিভোর থেকেছে পাঠকরা। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কম নেই। ফেলুদা, ব্যোমকেশ সবাই সক্রিয়ভাবে বিরাজ করছেন আজও। কিন্তু, সবাই কলকাতায় থাকেন। রহস্য ধরতে হিল্লি-দিল্লি যান। সেখানে সমরেশের গল্পের গোয়েন্দা, তথা, সত্যসন্ধানী অর্জুন জলপাইগুড়ির ছেলে। কলকাতাতেও কেস সলভ করতে আসেন। কিন্তু তার আসল জায়গা জলপাইগুড়ি। লেখালেখির জগতেও প্রবেশ বাংলার একটি বিখ্যাত পত্রিকার হাত ধরে। প্রথম লেখা প্রকাশ ওখানেই। পরে কর্মসূত্রেও জড়িয়ে ছিলেন বাংলার একটি প্রথমসারির পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে। তবে সমরেশ মজুমদারকে একধাক্কায় খ্যাতির আলোয় নিয়ে আসে তার বিখ্যাত ‘ট্রিলজি’। ‘উত্তরাধিকার’ যার প্রথম খন্ড। পরের খন্ড ‘কালবেলা’ আজও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক ক্লাসিক বলে স্বীকৃত। কলকাতার উত্তাল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা স্লোগান, বিপ্লব, রক্ত, বোমা ও প্রেমের এক তোলপাড় ফেলা কাহিনীর জন্য ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাকে।

শহরকেন্দ্রিক জীবনের আলেখ্য বারবার উঠে এসেছে সমরেশ মজুমদারের লেখায়। যে কারণে তাঁকে আপাদমস্তক ‘আরবান’ লেখক বলে অনেক সময় বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এরই পাশাপাশি নিজের শৈশব–কৈশোরের চা–বাগানের জীবন, শ্রমিক, রাজনৈতিক নেতা থেকে ছোট ছোট চরিত্র ঘুরেফিরে এসেছে শুধু তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলোতেই নয়, ছোটগল্পেও। ঘরোয়া আড্ডার সময়ও খুব মনোযোগ দিয়ে কৈশোরের এই চরিত্রগুলোকে তুলে ধরতেন তিনি। মফস্বল শহর, তার মানুষ, জলপাইগুড়ির আশেপাশে তিস্তা, তোর্সা ইত্যাদি নদী ছাড়িয়ে জলদাপাড়া, মাদারিহাট, বীরপাড়া, মালবাজার, রাজাভাতখাওয়া, হলং, গরুমারা ইত্যাদি ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গলে আর চা বাগানে ঘেরা এক প্রাকৃতিক পরিবেশে গজিয়ে ওঠে নানা ভয়ানক রহস্য। ‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’, ‘খুনখারাপি’, ‘কালিম্পং-এ সীতাহরণ’ ইত্যাদি গল্পে দুরন্ত রহস্য সমাধান করে অর্জুন। তার লাল মোটরবাইক কার্যত এক ‘আইকনিক’ অংশ হয়ে ওঠে গল্পের। লেখক অর্জুনকে শুধু বাংলাতেই আটকে রাখেননি। নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায়, অর্জুন কেস ধরেছে একেবারে নিউইয়র্ক সিটিতে।

সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের বিষয়, গল্প ও গঠনশৈলী ছিল গতানুগতিক ধারার বাইরে। সহজেই তিনি দুই বাংলার পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সমরেশ মজুমদার ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাকার। কলকাতা বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রপতনে সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।