পদ্মা সেতু: অর্জন ও গৌরবের নাম

জাহিদুর রহমান উজ্জল :
নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে অবশেষে প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর মাথা দাঁড় করালো আমাদের টাকায় নির্মিত পদ্না বহুমুখী সেতু। এটা জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় চ্যালেঞ্জ। এই সফলতা অর্জন ছিলো বিশ্বে তাক লাগানোর মতো। সারা বিশ্বের বিস্ময় এই পদ্মা সেতু আমাদের উচ্চ আসনে তুলে দিলো। স্বাধীনতার পর এটা আমাদের একটি বড় অর্জন।

একটি দেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে কতোটা এগিয়ে গেছে তার একটি প্রতীক এই সেতু। নদীর ওপর সেতু হলে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দুয়ার খুলে যায়। একটি এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু এই সেতু সারা দেশের উন্নয়নকে জাগিয়ে তুলবে। এটা সত্যিই উন্নয়নের মাইলফলক।

প্রমত্তা পদ্মার ঢেও তার খরস্রোত এক সময় পদ্মাপাড়ের মানুষের জন্য অভিশাপ ছিলো। নদীর দুকূলের মানুষেরা সর্বশান্ত হতো। নদীর করালগ্রাসে ভাঙ্গনে মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছে।

একসময় হুয়াংহো নদীকে ‘চীনের দু:খ’ বলা হত। প্রাচীন চীনে প্রায়ই হুয়াংহো নদী ছাপিয়ে উঠে সবকিছু বন্যায় ভাসিয়ে দিত বলে এই নদীর নাম ছিল ‘চিনের দু:খ’। নয়াচীন গঠন হওয়ার পর উজানে বাঁধ ও নদীশাসনের ফলে নদীটি আর্শিবাদ হয়ে উঠে।

পদ্মানদীর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়, পদ্মা মূলত গঙ্গা নদীর নিম্নস্রোতধারা নাম। অতিতে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত নদীকে গঙ্গা হিসাবে চিহ্নিত করা হতো। পরবর্তীতে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে যমুনার সঙ্গমস্থল থেকে ভাটিতে মিলিত প্রবাহকে পদ্মা নামে ডাকা হয়।

হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গা নদী রাজশাহী জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, এখান থেকে নদীটি পদ্মা নাম ধারণ করেছে। গঙ্গার অন্য শাখাটি ভাগীরথী নামে ভারতে হুগলীর দিকে প্রবাহিত হয়। উৎপত্তিস্থল হতে ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে মিলিত প্রবাহ পদ্মা নামে আরও পূর্ব দিকে চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। সবশেষে পদ্মা-মেঘনার মিলিত প্রবাহ মেঘনা নাম ধারণ করে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়।

রাজশাহী থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত এই পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার, সেখান থেকে চাঁদপুরের মেঘনা পর্যন্ত ১০৪ কিলোমিটার। পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতুর স্বপ্ন ছিলো সারাদেশের মানুষের। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ছিলো প্রাণের দাবি। একটি স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন হলো।

মানুষের প্রাণের কথা বুঝেন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাই তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো পদ্মার ওপর ৬.১৫০ কিলোমিটার পদ্মা সেতু নির্মাণের।

সে মেতাবেক শুরু হয় নির্মাণ পরিকল্পনা।

কারো কাছে মাথা নত না করে নিজেদের টাকায় গর্বের পদ্মা সেতু করে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিলেন ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না”। ধিরে ধিরে গড়ে ওঠে অর্জনের গৌরবের পদ্মা সেতু।

সম্পূর্ণ নিজস্ব টাকায় দেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা পদ্মা সেতু। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। ২ তলা বিশিষ্ট এই সেতুর এক অংশ পদ্মা নদীর মাওয়া প্রান্ত এবং অপর অংশ নদীর জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। একই সঙ্গে রেল ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুতে। চারলেন বিশিষ্ট ৭২ ফুট প্রস্থের এ সেতুর নিচতলায় রয়েছে রেল লাইন।

পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ উদ্বোধন করেন। এরপর একে একে সব ধাপ পেরিয়ে পদ্মার বুকে ৪২টি পিলারের ওপর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে স্বপ্নের সেতু। সেতুটির নকশা তৈরি করেন এইসিওএম এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ছিল চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।

এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়ন হবে চোখে পড়ার মতো। শিল্পকারখানা স্থাপনের পাশাপাশি কৃষি ও মৎস্য সম্পদের বাজারজাতকরণ সুবিধা বেড়ে যাবে। প্রকৃত চাষীরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে ও সঠিক মূল্যে বিক্রয় করতে পারবে। এক কথায় বলা যায় দেশের উন্নয়নে পদ্মা সেতু সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে গেলো। এই সেতু শুধু প্রমত্তা পদ্মার পারাপারের ভূমিকা রাখবেনা; দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সমৃদ্ধির নতুন পথ উম্মোচন হলো।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মাকে ভালোবেসে বলেছেন, ‘হে পদ্মা আমার, তোমায় আমায় দেখা শত শত বার। তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরাণ। চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে।’

কখনো আবার বলেছেন, ‘ইন্দ্রের আছে ঐরাবত, আমার তেমন পদ্মা।’

এই ছিন্নপত্রে তিনি বলেছেন ‘বাস্তবিক আমি পদ্মাকে ভালোবাসি।’ তিনি এতোটাই পদ্মা নদীকে ভালোবাসতেন তাঁর বোটটির নামই দিয়ে দিলেন ‘হাইজ বোট পদ্মা’, এমনকি শিলাইদহের কাছারি বাড়ির দেয়াল নির্মাণ করেন পদ্মার ঢেউ এর মতো। আসলে বিশ্ব কবি পদ্মানদীর প্রেমে পড়েছিলেন। তেমনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পদ্মা নিয়ে বলেছেন, ‘পদ্মার ঢেউ রে –
ও মোর শূন্য হৃদয় – পদ্মা নিয়ে যা রে…।’

তেমনি পদ্মার ইলিশ নিয়ে লিখেছেন কবি বুদ্ধদেব বসু
‘রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে।এলো বর্ষা, ইলিশ -উৎসব।’

এতো কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, রচনায় বার বার যে নদীটির নাম এসেছে সেই আমাদের গর্বের ধন। যার জন্য সারা বিশ্বে মাথা উঁচু করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বলতে পারছি ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’।

পদ্মা সেতু স্বপ্নের নয়, এখন বাস্তব। জননেত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিশমাটিক ছোঁয়ায় দেশের টাকায় স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো। এটা কম কিসের? মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখে তা বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু যিনি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেন তাঁর স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়ন হয়। এটা জননেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে বাস্তব উদাহারণ। আজ এই সেতুর উদ্বোধনের ঐতিহাসিক দিনে জয়তু শেখ হাসিনা পদ্মার বিশালতার মতো হৃদয় নিয়ে বেঁচে থাকুন। এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মাদারগঞ্জ উপজেলা শাখা।