জামালপুরের কথিত ‘পাওয়ারফুল মিনিস্টার’ পত্নী জেলহাজতে

বিচারকের খাসকামরায় ঢুকে হুমকিদাতা কথিত ‘পাওয়ারফুল মিনিস্টার’ পত্নী আরিফা। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

আগের দিন স্বামী শফিকুল ইসলাম জামালপুরের একজন বিচারককে হুমকি দিয়েছেন ফোনে সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নাতি পরিচয়ে। পরের দিন স্বামী ‘পাওয়ারফুল মিনিস্টার’ বলে আরেক বিচারককে ভয় দেখিয়েছেন স্ত্রী আরিফা নামের এক নারী। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি এখন জেলহাজতে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ও আগের দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি জামালপুর জেলা জজ আদালতে এ ঘটনা ঘটে।

এই অজ্ঞাত কথিত ‘পাওয়ারফুল মিনিস্টার’ দম্পতির হুমকিতে একদিকে জামালপুর জেলা জজ আদালতের বিচারকরা বিচারবিভাগ ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে বহিরাগত এক নারী খাসকামরায় ঢুকে বিচারককে ক্ষমতার ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনাটি আদালত অঙ্গনে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

আদালত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে প্রতারক শফিকুল ইসলাম নিজেকে সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব মিঞার আপন নাতি পরিচয়ে তাদের জমিজমা সংক্রান্ত একটি দেওয়ানি মামলার রায়ের আদেশের কপি পাওয়ার জন্য জামালপুরের অতিরিক্ত সহকারী জজ আদালতের সহকারী জজ এ কে এম ছিফাতুল্লাহকে ফোন করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতির আত্মীয় ও নিজে ওই মামলার বাদী পরিচয়ে ওই সহকারী জজকে ফোনে শফিকুল বলেন, ‘মামলাটির আদেশ কি হয়েছে? আদেশের কপিটি কখন পাবো? কখন দিবেন?’ এসব কথা বলে সহকারী জজকে বেশ চাপ প্রয়োগ করেন শফিকুল।

সহকারী জজ তখন বিষয়টি টের পেয়ে থানায় জিডি করা হবে বলে শফিকুলকে বলেন। এ সময় শফিকুল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উত্তেজিত গলায় থানায় জিডি করলে দেখে নিবে বলে সহকারী জজকে হুমকি দেন। ফোন কল কেটে দিলেও বারবার ফোন করে তাকে বিরক্ত করছিলেন শফিকুল ইসলাম। একপর্যায়ে ফের ফোন রিসিভ করলে শফিকুলের পাশে থাকা একজন নারী কণ্ঠ ভেসে আসে। ফোনের সময় ওই নারী পাশে থেকে বলছিলেন- ‘কে তিনি জিডি করবে। আমরা এখনই আসছি।’ এছাড়াও ওই নারী তার স্বামী শফিকুলের মোবাইল নম্বরটি নাকি সারা বাংলাদেশে এমনকি জাতীয় সংসদ ভবনেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে, বিচারক কেন এই নম্বর চিনে না বলেও হুমকি দেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতির আত্মীয় পরিচয়ে বাইরে থেকে ফোন করে একজন বিচারককে হুমকি ও বিরক্ত করার ঘটনা জানাজানি হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি জামালপুর জেলা জজ আদালতের সর্বস্তরের বিচারক, আইনজীবীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। এ ধরনের আচরণ বিচার বিভাগের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে সহকারী জজ এ কে এম ছিফাতুল্লাহর নির্দেশে তার আদালতের সেরেস্তাদার মো. মাহবুবুর রহমান বাদী হয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি জামালপুর সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। শফিকুল ইসলাম জামালপুর সদরের রানাগাছা ইউনিয়নের কানিল গ্রামের চান মিয়ার ছেলে। তবে তার পেশা এবং সঠিক পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি আদালত কর্তৃপক্ষ।

এদিকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ফোনে হুমকি দেওয়ার সময় শফিকুল ইসলামের পাশে থেকে নারী কণ্ঠের সেই নারী আরিফা (৩৬) স্বয়ং নিজে ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে জেলা জজ আদালত ভবনের দোতলায় একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী জজের খাসকামরায় হাজির হয়ে একই বিষয় নিয়ে ফের হুমকি দিয়ে বিচারকসহ সবাইকে হতবাক করে দিয়েছেন। এ সময় আরিফা তার স্বামী শফিকুল ‘পাওয়ারফুল মিনিস্টার’ দাবি করে তার ক্ষমতার দাপট দেখান। একপর্যায়ে পুলিশ কোর্ট থেকে একজন নারী পুলিশ সদস্যসহ পুলিশ ডেকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে আরিফাকে আটক করে আদালতের গারদখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সহকারী জজ মো. মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, আরিফার পুরো নাম বলেছে ফাতিমা জান্নাত মোছা. আরিফা মাদানী। তিনি তার এলাকা জামালপুর সদরের নান্দিনায় পিএইচ আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষক বলেও নিজেকে দাবি করেন। এই প্রতারক নারীর আচরণেও আজকে আমরা হতবাক হয়েছি। আরিফা ১৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কাউকে বুঝতে না দিয়ে সরাসরি আদালত ভবনের দোতলায় জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ ইকবাল মাহমুদের খাসকামরায় ঢুকে পড়েন। কথিত শফিকুল তার স্বামী পরিচয়ে তাদের দেওয়ানি মামলার রায়ের আদেশের কপির জন্য বেশ প্রভাব ও হুমকি দিয়েছেন। শফিকুলের পেশা বা বিস্তারিত পরিচয় জানতে চাইলে শফিকুল নাকি একজন ‘পাওয়ারফুল মিনিস্টার’, তার পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না বলে জানায় আরিফা। বাংলাদেশের মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করা যাবে না কেন জানতে চাইলে আরিফা তার আগের কথায় অটল থেকে বলেন শফিকুল দেশের বাইরে আছেন। এছাড়াও সাবেক প্রধান বিচারপতির আত্মীয় হওয়া, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ দেশের সকল ওসি, ডিসি, মন্ত্রীদের ফোন নম্বরও তার কাছে আছে বলে হুমকি দেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও নাকি তার কথা হয় বলেও হুমকি দেন আরিফা।

সহকারী জজ মোস্তাফিজুর রহমান আরও জানান, শফিকুল ফোনে এবং বিচারকের খাসকামরায় এসে হুমকিদাতা আরিফা যে মামলার বিষয়ে এমন আচরণ করছেন সেই মামলাটির রায় তাদের পক্ষেই গেছে। আদেশের কপিটাও তারা তুলতে পারবে। কিন্তু তাদের দু’জনের আচরণ খুবই সন্দেহজনক, একই সাথে বিচারকদের দৈনন্দিন কার্যক্রম ও জীবনের নিরাপত্তা হুমকিস্বরূপ। এ ঘটনায় শফিকুল ও তার স্ত্রী আরিফাকে আসামি করে মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফোনে হুমকিদাতা শফিকুলকে গ্রেপ্তার করা গেলে হয়তো তার সম্পর্কে এবং তার হুমকির উৎস সম্পর্কে তখন বিস্তারিত জানা যাবে। তারা দু’জন আদৌ স্বামী-স্ত্রী কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার। আদালতের নির্দেশে গ্রেপ্তার আরিফাকে আদালতের গারদখানা থেকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।