চিকিৎসক সুলতানা পারভীনকে হত্যা করা হয়েছে, দাবি তার বাবা’র

হাসপাতালের আবাসিক ভবনের নিজ কক্ষে চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের মরদেহ (ইনসেটে চিকিৎসক সুলতানা পারভীন)। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার (স্ত্রীরোগ) চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের মুখমন্ডলে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম ও গলায় শ্বাসরোধ করে হত্যার কালচে চিহ্ন থাকা একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। সেই ছবি দেখেই তার বাবা দাবি করেছেন, চিকিৎসক সুলতানা পারভীনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্যাথেডিন নিয়েই যদি তার মেয়ে আত্মহত্যা করে থাকেন, তাহলে তার মুখে আঘাতের চিহ্ন কেন, এই প্রশ্ন রেখে তার মেয়ের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের বাবা রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিদর্শক মুক্তিযোদ্ধা মো. আলাউদ্দিন আজাদ।

জানা গেছে, মেলান্দহ উপজেলা হাসপাতালের আবাসিক এলাকায় নিজ কক্ষ থেকে চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের (৩৭) মরদেহ উদ্ধার করা হয় গত ১৬ আগস্ট বিকেলে। মেলান্দহ থানা পুলিশ ওইদিন মরদেহ উদ্ধার করে জামালপুর মর্গে পাঠায়। পরের দিন ১৭ আগস্ট ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের স্বজনরা তার মরদেহ তাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলা সদরের পোস্ট অফিস গলি এলাকায় নিয়ে দাফন করেন।

মরদেহ উদ্ধারের সময় পুলিশ তার বিছানা থেকে পাঁচ শিশি প্যাথেডিন, একটি সিরিঞ্জ, একটি নোটবুক এবং দুটি চিঠি উদ্ধার করে। তখন প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের কক্ষ থেকে জব্দ করা নোটবুক ও দুটি চিঠি থেকে সাব্বির নামের এক ব্যক্তির সাথে তার সম্পর্ক থাকার বিষয়টি জেনেছিল পুলিশ। সাব্বির নামের ওই ব্যক্তির বাড়ি চট্টগ্রামের খুলশি থানা এলাকায়। তিনি বুয়েট থেকে পাশ করে প্রকৌশলীর চাকরি করেন। কোথায় চাকরি করেন সুলতানা পারভীনের বাবা তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। পারিবারিকভাবে সাব্বিরের সাথে চিকিৎসক সুলাতানা পারভীনের বিয়ে হলেও বছর ছয়েক আগে তাদের বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক মেসেনজারের মাধ্যমে চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের মরদেহ উদ্ধারের আগ মুহূর্তের কয়েকটি ছবি ভাইরাল হওয়ায় সব শঙ্কা ও অনুমান ছাপিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার শতভাগ সম্ভাবনার বিষয়টিই সবার সামনে চলে এসেছে। বহুল আলোচিত সেই ছবি বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিজ কক্ষের বিছানায় পড়ে থাকা চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের শরীর একটি চাদর দিয়ে ঢাকা, ঠোঁট কাটা ও থেতলানো রক্তমাখা মুখমন্ডল, চোখ ও কপালে ফোলাজখম, দুই হাত ও বুকের দিকেও রক্তাক্ত কালচে জখমের চিহ্ন রয়েছে। আর ওই কক্ষের জানালা দিয়ে বাইরে দিনের আলো দেখেই বোঝা যায় ঘটনার দিন বিকেলে দরজা ভেঙে ভেতরে যারা ঢুকেছেন তাদের মধ্যেই কেউ হয়তো ছবিগুলো তুলেছিলেন।

মেয়ের এভাবে মৃত্যুর বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তার শোকার্ত বাবা আলাউদ্দিন আজাদ। এ ঘটনায় তিনি মেলান্দহ থানায় অজ্ঞাত আসামি উল্লেখ করে একটি মামলা দায়েরের উদ্দেশে গত ২১ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে জামালপুরে আসেন। তার সাথে ছিলেন তার তৃতীয় মেয়ে মেরিনা পারভীন ও দ্বিতীয় মেয়ে শাহনাজ পারভীনের স্বামী আসাদুল হাফিজ। মেরিনা পারভীন এবার ৩৮তম বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে সরকারি চাকরিতে যোগদানের সুপারিশ পেয়েছেন। রাতেই মেলান্দহ থানায় যাওয়ার আগে তারা সুলতানা পারভীনের মৃত্যুর বিষয়ে জামালপুর প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেন।

সাংবাদিক সম্মেলনে তাদেরকে চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের সেই ছবি দেখানো হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। ছবিটি দেখে আলাউদ্দিন আজাদ তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমার মেয়ের মৃত্যুর ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে আমাদেরকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। তার কক্ষে প্যাথেডিনের অ্যাম্পুল পাওয়ার কথা পুলিশ ও চিকিৎসকরা বলেছিলেন। আমার মেয়ে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বিসিএস ক্যাডারের অফিসার ছিল। গরিবের ডাক্তার বলে জামালপুরে তার অনেক সুনাম রয়েছে। এমন একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে না। যেকোন একজন মানুষ যদি প্যাথেডিন আসক্ত হয়েই মারা যায়, তাহলে তার মুখের বা শরীরের এই বীভৎ অবস্থা হবে কেন? শরীরে অতিমাত্রায় প্যাথেডিন ইনজেকশ নিলে তার নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার কথা ছিল।

তিনি দাবি করে বলেন, মরদেহ উদ্ধারের আগে পুলিশ ও ডাক্তার-কর্মচারীদের উপস্থিতিতে আমার মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হলেও তার মুখমন্ডল ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম এবং শ্বাসরোধে করে হত্যা করার মতো গলায় কালচে দাগ ছিল। বিষয়টি ওই দিন আমাদেরকে কেউ জানতে দেয়নি। আমাদের অনেক দেরিতে খবর দিয়েছে পুলিশ। মরদেহ দেখার জন্য সাহায্য চাইলেও অনুমতি দেয়নি স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। আমার মেয়ের ময়নাতদন্তের বিষয়েও অনেক গাফিলতি করা হয়েছে। মর্গের বাইরে খোলা জায়গায় তার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। একজন বিসিএস ক্যাডারের সরকারি চিকিৎসক হয়েও পেশাগত কোন সহমর্মিতা পায়নি সে। ডোমের কাছ থেকে শুনেছি, আমার মেয়ের পরনে লালরঙের হাতাকাটা একটি টেপ গায়ে ছিল। তার পরনে কোন কাপড় ছিল না। আমার মেয়ের মৃত্যু নিয়ে এতো কিছু লুকোছাপা ও অবহেলা করার পেছনে নিশ্চয় কোন রহস্য আছে। এ ঘটনার সঠিক তদন্ত হলেই কারা কারা আমার মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যার সাথে জড়িত রয়েছে তা বেরিয়ে আসবে। আমি আমার ডাক্তার মেয়ে হত্যার সঠিক বিচার চাই।

এছাড়াও মেয়ের এভাবে মৃত্যুর পেছনে সম্ভাব্য দুটি কারণ উল্লেখ করেন আলাউদ্দিন আজাদ। তিনি বলেন, প্রথমত আমার মেয়ের সাবেক স্বামী সাব্বির ও দ্বিতীয়ত পেশাগত ঈর্ষা। বছর ছয়েক আগেই সাব্বিরের সাথে আমার মেয়ের বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। শাশুড়ি সাথে তার বনিবনা হতো না। এরপরও সাব্বির বিভিন্ন সময়ে আমার মেয়েকে এসএমএস দিয়ে এবং ফোন করে উত্যক্ত করতো। কিন্তু আমার মেয়ে তার ডাকে আর সাড়া দেয়নি। ফলে এ নিয়ে আমার মেয়ের মধ্যে একধরনের দুঃচিন্তা কাজ করতো। সাব্বিরের দুঃসম্পর্কের এক মামা মেলান্দহ উপজেলা হাসপাতালের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মচারী মকবুল হোসেন মোর্শেদ সম্প্রতি মেলান্দহ থেকে বদলি হয়ে গেলেও কয়েকদিন আগে তিনি মেলান্দহে এসেছিলেন। আমার মেয়েকে হত্যার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে তার সাবেক স্বামী সাব্বির ও তার মামা মকবুলের হাত থাকতে পারে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হলে হয়তো সুলতানা পারভীনের মৃত্যু নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলতে পারে। এছাড়া জামালপুর শহরের একটি ক্লিনিকে নিয়মিত রোগী দেখা ও প্রসূতির অস্ত্রোপচারের বিষয়টি নিয়েও বিভিন্ন সমস্যায় পেশাগত ঈর্ষার শিকার হয়েছিলেন বলে মাঝে মধ্যেই সুলতানা পারভীন পরিবারের সদস্যদের সাথে কথাবার্তা বলতেন।

এদিকে ২২ আগস্ট রাতে আলাউদ্দিন আজাদ বাদী হয়ে তার ডাক্তার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ এনে মেলান্দহ থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ের আসামি উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। তারা জেলার সিভিল সার্জন চিকিৎসক প্রণয় কান্তি দাসের সাথে ডাক্তার সুলতানা পারভীনের মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলে সঠিক প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানিয়ে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন চিকিৎসক প্রণয় কান্তি দাস এ প্রতিবেদককে বলেন, জামালপুর সদর হাসপাতালের তিন সদস্যের একটি চিকিৎসক দল চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছে। ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য কিছু আলামত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেখানকার প্রতিবেদন হাতে পেলেই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানো হবে।

মেলান্দহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রেজাউল ইসলাম খান এ প্রতিবেদককে বলেন, চিকিৎসক সুলতানা পারভীনের বাবা আলাউদ্দিন আজাদ বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামি উল্লেখ করে ২২ আগস্ট রাতে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।