বায়োস্কোপের কাহিনী!

জাহিদুর রহমান উজ্জল॥
ছোট সময়ে আমাদের বাড়িতে বগুড়া থেকে একজন বৃদ্ধ নিয়মিত আসতো। সাথে থাকতো একটি বড় আকারের পোটলা। ওই পোটলার ভিতর থাকতো বায়োস্কোপ। সেটা দিয়ে মক্কা মদিনার দৃশ্য দেখিয়ে হাট বাজারে টাকা উপার্জন করতো। লোকটির নাম ছিলো ওসমান গনি। তার কাছে দেখা ছিলো আমার প্রথম বায়োস্কোপ। একটি কাঠের স্টেন্ড দিয়ে উঁচু করে তাতে ওই বায়োস্কোপ লাগিয়ে ছন্দ বলে ফ্লিম ঘুরিয়ে দেখাতো। দু’চোখ লাগিয়ে আমি মনের সুখে ওইসব ছবি দেখতাম। ওসমান চাচা ছবি দেখতে আমার কাছ থেকে কোন দিন পয়সা নেয়নি। কারণ তিনি বগুড়া থেকে এসে আমাদের কাছারি ঘরে থাকতেন। আমার বাবার সাথে তার সক্ষতা ছিলো। বগুড়ার গাবতলী হয়তো তাঁর বাড়ি। যে কদিন জামালপুরের মাদারগঞ্জে থেকে ব্যবসা করতো প্রতিরাতে আমাদের বাড়িতে রাত্রি যাপন করেছেন। সকালে ও রাতে দু বেলা তাকে আমার বাবা খাওয়াতো। ওই পেশা নিয়েই তিনি পবিত্র হজে¦র ছবি ও মত্তা মদিনার দারূন রঙিন ছবি দেখাতো। শুধু ছবি নয় মুখে মুখে ছড়া কেটে ছবির হৃদয়স্পর্শি বর্ণনাও দিতো। ওসমান চাচার বায়োস্কোপ দেখার পর সম্ভবত ভেলামারী থেকে একজন লাল পোষক পড়া ব্যক্তি ইয়াবড় একটি বক্স নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘সিনেমা’ দেখাতো। তার ওই বাক্সের ভিতর উঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতাম। রঙিন ছবি ছবি দিয়ে আতসী কাছে বড় বড় দৃশ্য দেখতাম। আর বায়োস্কোপওয়ালা হাতে ‘খুঞ্জরী’ বাজিয়ে ছন্দ বলে যেতো। যা স্থানীয় ভাষায় ‘ছিগলী’ বলা হয়ে থাকে। ওই ছিগলীতে তিনি সুর তুলে বলে যেতেন- তার পরে তে দেখা গেলো রাজা রাণী আইসা পইলো…।

এই মাধ্যম ছাড়া তখন রেডিও ব্যতিত কোন বিনোদন মাধ্যম ছিলো না। এই বায়োস্কোপগুলি ছিলো গ্রামের ছেলেপেলেদের প্রথম বিনোদন। এই বিনোদনের পর মাদারগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘উদয়ন’ একবার ভ্রাম্যমাণ সিনেমা দেখানোর আয়োজন করেছিলো। সেই কি মহাযজ্ঞ। কয়েকদিন চেষ্টা করে জেনারেটরের বিদ্যুৎ দিয়ে ‘আপন দুলাল’ ছবির কয়েকটা দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পরে জামালপুর জেলা শহরে সিনেমা হলগুলো ছিল মাদারগঞ্জবাসীর বিনোদন। কথাকলি, নিরালা, হলনাগাদে সুরভী সিনেমা হলগুলো ছিল। এখানে সিনেমা দেখতাম।

যাই হোক মাদারগঞ্জে বিনোদন বা বায়োস্কোপের সূচনা করলেন তানজীনা টকিজ। এঁরা বালিজুড়ি বাজারে হয় আশির দশকের মাঝামাঝি। সাদী স্যার ও একজন সরকারী কর্মকর্তা মিলে এই সিনেমার হলটি প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে ওপরে টিনের চালায় হলটি চলতো। প্রথমে ছোট মেশিনে পুরাতন সাদাকালো ছবি প্রর্দশন করতো। কি আজব ব্যাপার বলে মনে হতো গ্রামের মানুষের কাছে।

আমরা ছবি দেখতাম। আড্ডা দিতাম সিনেমার হলে। আমাদের বড়দের আড্ডারস্থলও ছিল তানজিনা টকিজ। অনেক ঘটনা ছিলো সিনেমার হলকে নিয়ে। মাদারগঞ্জের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ ছিল সিনেমার হল। পরে সিনেমার হলে বড় মেশিন সংযুক্ত হয়। আংশিক রঙিন ছবি আসে, আসে সম্পূর্ণ রঙিন ছবি। দর্শক বাড়ে, আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় হলটি। বিনোদন থমকে যায়। তখন মাদারগঞ্জে বিদ্যুৎ ছিল না। দু একটি টেলিভিশনই বিনোদন মাধ্যম হয়ে পড়ে। আমাদের সাদাকালো টেলিভিশনটি ছিলো আমার বিনোদনের বড় মাধ্যম। বালিজুড়ি বাজারের উদয়নের টেলিভিশন ছিলো একটি বড় বিনোদন। শুক্রবারের বিনেপয়সার সিনেমা দেখার জন্য উপচে পড়তো দর্শক। সে ইতিহাস খুব দীর্ঘ। অনেকদিন কাটার পর বালিজুড়িতে আরো একটি সিনেমার হল স্থাপন করার জন্য উদ্যোগ দেন মেলান্দহের দুজন তরুণ ব্যবসায়ী। একজন সফেন অন্য জন মোস্তফা। জমি কিনে ‘স্বজন’ সিনেমা প্রতিষ্ঠা করেন। খুব ভালো ব্যবসা করেছে তারা। ভালোমানের ছবি দিয়ে দর্শকদের মন জয় করলো। সিনেমা হলটি খুব নাম করেছিল। তার পর একদিন বন্ধ হয়ে গেলো হলটি। স্মৃতির পটে পড়ে রইলো বায়োস্কোপের কাহিনী।