শেরপুরের শাক-সবজির বাজারে চরম মন্দা : লোকসানের মুখে লাখো প্রান্তিক চাষি

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

করোনাভাইরাস অস্থীরতার কারণে শেরপুরের শাক-সবজির বাজারে বিরাজ করছে চরম মন্দাবস্থা। ফলে লোকসানের মুখে পড়েছে সীমান্তবর্তী এ জেলার লাখো প্রান্তিক চাষি। চাষিরা জানায়, শীত মৌসুমে সবজি বিক্রি করে তারা কিছুটা লাভের মুখ দেখলেও এখন উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না। বর্তমানে সদর উপজেলাসহ নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদীর পাইকারি বাজারে ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, বেগুন, শিম, টমেটো, শশা, গাজরসহ অধিকাংশ সবজিই নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষতি পুষাতে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের প্রণোদনা দিতে সরকারকে বিষয়টি জানানো হবে বলে জানিয়েছেন কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৮ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ করা হয়। এরমধ্যে শেরপুর সদর উপজেলাতেই ৪ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারেরা শেরপুরে এসে উৎপাদিত সবজির অধিকাংশই ক্ষেত বা স্থানীয় হাটবাজার থেকে কিনে নিয়ে যান। এ জন্য উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে কৃষকেরা সবজির ন্যায্যমূল্যও পেয়েছিলেন। করোনাভাইরাস আতঙ্কে টানা আটদিন ধরে ট্রাকসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে সবজি কিনতে ঢাকা থেকে পাইকারেরাও আসছেন না। এতে শেরপুরের বাজারগুলোয় সবজির দামে ধস নেমেছে। পচে যাওয়ার আশঙ্কায় কৃষকেরা এখন অধিকাংশ সবজিই বেশ কম দামে বিক্রি করছেন।

১ এপ্রিল সকালে সদর উপজেলার পাইকারি হাট কুসুমহাটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকেরা ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, বেগুন, শিমসহ বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ সবজি বাজারে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু পাইকারের অভাবে সেগুলো বিক্রি করতে পারছেন না। স্বল্পসংখ্যক স্থানীয় পাইকার বাজারে আনা সবজির দাম বলছেন খুবই কম।

স্থানীয় কৃষক হোসেন আলী বলেন, বেগুনের কেজি ৩০ টাকা থেকে ৪ টাকায় নেমেছে। শশার কেজি ৫ টাকা, কাঁচামরিচের কেজি ৩৫ টাকা, এক বোঝাডাটা (৮০টি) ২০ টাকা, গাজরের কেজি ৫ টাকা এবং টমেটো ৪ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। নতুন সবজি সজনার কেজি ৭০ টাকা। করলার ধরা (পাঁচ কেজি) ১০০ টাকা।

সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নের ঘিনাপাড়া গ্রামের কৃষক হারুনুর রশীদ বলেন, এক বিঘা জমিতে ফুলকপি আবাদ করেছিলেন। এ জন্য ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। উৎপাদন ভালো হয়েছে। আগে ঢাকা থেকে পাইকারেরা ক্ষেতে গিয়ে ১০০ কপি ৫০০ টাকায় কিনেছেন। কিন্তু এখন পাইকার না আসায় ক্ষেত থেকে কপি বাজারে নিয়ে এসেছেন। স্থানীয় পাইকারদের কাছে ১০০ কপি ১৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে তার অনেক লোকসান হবে বলে জানান।

সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২৫ শতাংশ জমিতে বাঁধাকপি চাষ করছিলাম। আগে পাইকারেরা ক্ষেত থাইক্যা ১০০ কপি ৮০০ ট্যাহায় কিনত। কিন্তু অহন পাইকারেরা ১০০ কপির দাম ১০০ ট্যাহা বলতাছে। এই দামে বেচলে আমার অনেক লোকসান হবো। কিন্তু না বেইচা কী করুম? বাড়িত ফিরত নিয়া গেলে ভ্যান ভাড়া দিমু কই থাইক্যা?

কৃষক আবদুর রশীদ বলেন, ৩৫ শতাংশ জমিতে তিনি বেগুন আবাদ করেছিলেন। মৌসুমের শুরুতে এক মণ বেগুন ৭০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে পাইকাররা না আসায় ৩১ মার্চ এক মণ বেগুন ৪৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন।

বামনেরচর এলাকার কৃষক তাজ উদ্দিন, মালেক ও ইয়াদ আলী বলেন, লোকসানে সবজি বিক্রি করে চোখে পথ দেখছেন না। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে সবজির দাম আরও কমে যেতে পারে বলে তাদের ধারণা। আর তখন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।

কুসুমহাটি বাজারের সবজি ব্যবসায়ী উজ্জ্বল মিয়া বলেন, সবজি উৎপাদনে শেরপুরের খ্যাতি দেশব্যাপী। কিন্তু করোনা আতঙ্কে শেরপুরের সবজির বাজারে ধস নেমেছে গত দুই সপ্তাহ ধরে। বাজারে মানুষ নাই, সবজি ঢাকায় যাচ্ছেনা। একদিকে নির্দিষ্ট সময় পরে সবজি ক্ষেতে রাখা যায়না, অপরদিকে পচনশীল পণ্য বলে কৃষক কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে লোকসানের মুখে হতাশগ্রস্ত সীমান্তবর্তী এ জেলার লাখো প্রান্তিক চাষি।

সবজির দাম অনেকটা কমে গেছে বিষয়টি স্বীকার করে জেলা কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচলক ড. মোহিত কুমার দে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দিতে সরকারকে জানানো হবে। সরকার কৃষিবান্ধব তাই এই মহাদূর্যোগে অবশ্যই কৃষকদের পাশে দাঁড়াবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।