নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য নজির জহুরা বেগম

নিজ খামারে গরুর পরিচর্যা করছেন সংগ্রামী নারী জহুরা বেগম। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি
বাংলারচিঠিডটকম

জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের উত্তর কুশলনগর গ্রামের জহুরা বেগম। তিনি এখন সফল খামারি, ইউপি সদস্য ও একটি (কমিউনিটি বেজড অর্গানাইজেশন) সিবিও’র সভাপতি। নিজের মেধা, যোগ্যতা ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।

১৯৯৩ সালে উত্তর কুশলনগর গ্রামের নুর ইসলামের সাথে বিয়ে হয় ফরিদপুর জেলার মেয়ে জহুরা বেগমের। বিয়ের পর অভাব অনটন পিছু নেয় নুর ইসলাম-জহুরার সংসারে। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা ছিল এই সংসারে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো জহুরা ও তার পরিবারের। স্বামীর তিন ভাই ও তিন বোনের দায়িত্বও পড়ে যায় জহুরা দম্পতির উপর। পরিবারের সদস্য সংখ্যার তুলনায় রোজগার কম থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েন জহুরা বেগম। স্বামী নুর ইসলাম দিন মজুরির কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনো মতে দিন চলত এই সংসারের।

উপয়ান্তর না দেখে ঢাকায় যেতে বাধ্য হয় নূর ইসলাম ও জহুরা বেগম। জীবনজীবিকার তাগিদে দুজনই কাজ নেন গার্মেন্টস কর্মীর। চলতে থাকে জীবন সংগ্রাম। এর মধ্যে ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক ছেলে ও এক মেয়ে। পাঁচ বছর গার্মেন্টসে কাজ করার পর ঢাকার খিলগাওয়ের একটি ফুটপাতে ভাত বিক্রি (ছোট হোটেল) শুরু করেন এই দম্পতি। দিনরাত পরিশ্রম করে হোটেল ব্যবসা করে কিছু অর্থ আয় করে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়ি উত্তর কুশলনগরে। ঢাকায় গার্মেন্টস ও ব্যবসা করে যে টাকা আয় হয় দেবর ও নদদের বিয়ে দিতেই শেষ হয়ে যায়। সংসারে ফের অভাব অনটন শুরু হয় ।

এরপর ২০১২ সালে দাতা সংস্থা অক্সফ্যামের সহযোগিতায় রি-কল প্রকল্পের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হন পরিশ্রমী নারী জহুরা বেগম। গ্রামের অন্যান্য নারীরা তাকে গ্রাম ভিত্তিক সংগঠন (সিবিও) উত্তর কুশলনগর শাপলা উন্নয়ন সংঘের সাথে যুক্ত হতে বলেন। দেরি না করে সিবিওতে আসা যাওয়া ও পরামর্শ নিতে শুরু করেন তিনি।

পরে রি-কল প্রকল্পের মাধ্যমে গরু পালন, মুরগী পালন প্রশিক্ষণ নেন জহুরা বেগম। শুধু তাই নয় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন অ্যাডভোকেসি সভা ও আয়বর্ধক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন জহুরা।

প্রথমে মুরগি পালন এবং একটি গাভী কিনে ছোট খামার তৈরি করে জীবন সংগ্রাম চলতে থাকে। এরপর নিজ যোগ্যতায় উত্তর কুশলনগর শাপলা উন্নয়ন সংঘের নির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। গরু পালন ও দুধ বিক্রি করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসতে থাকে তার। রি-কল প্রকল্পের নারীর নেতৃত্ব বিকাশ করতে হলে নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে এমন ধারনা নিয়ে নিজ গতিতে এগিয়ে যান সংগ্রামী নারী জহুরা বেগম।

২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যেই এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন জহুরা বেগম। সিবিও সদস্যদের নিয়ে নারী নির্যাতন, যৌতুক ও বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরমধ্যেই বদলে গেছে জহুরার সংসারের চিত্র। গরু পালন, হাঁস পালন, মুরগি পালন, কবুতর পালন করে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালের ৭ মে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য।

সংসারে এখন আর অভাব নেই জহুরার। এক ছেলে জহির ইসলাম এইচএসসি ও এক মেয়ে সানজিদা আক্তার সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে। নিজের আয় করা টাকায় ঘর নির্মাণ করেছেন, কিনেছেন জমিও। ফসল উৎপাদন করার পাশাপাশি চারটি গরুর দেখাশুনা করছেন জহুরা বেগম।

এই গ্রামের অন্যান্য নারীরাও এখন জহুরা বেগমকে অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। ইচ্ছা শক্তি আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে ভাগ্যের পরিবর্তন করা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি।

তবে তিনি হতাশও হয়েছেন। তার খামারে প্রতিদিন ৪ লিটার দুধ হয়। তার মত এলাকার শখানেক নারী গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করছে। খাদ্যপণ্যের দাম বেশি হওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। একই সঙ্গে বাজারজাতকরণের অভাবের কারণে দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা।

জানতে চাইলে উত্তর কুশলনগর শাপলা উন্নয়ন সংঘের নির্বাহী কমিটির সভাপতি ও ৬ নং নিলক্ষিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য জহুরা বেগম বাংলারচিঠিডটকমকে বলেন, উন্নয়ন সংঘ রি-কল ২০২১ প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকায় আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। তাদের দেওয়া পরামর্শের কারণেই আমার জীবন পরিবর্তনে প্রভাব ফেলেছে। রি-কল প্রকল্পের কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধের কারণে আমি ও আমার পরিবার সমাজে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে আছি। তাদের পরামর্শ না পেলে হইত আজকে জনপ্রতিনিধি হওয়া সম্ভব হতো না। তিনি যতদিনই বেঁচে থাকবেন ততদিন রি-কল ২০২১ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন বলেও অঙ্গীকার করেন।