জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় চলতি রোপা আমন মৌসুমে বর্ষালী ধানের বীজ রোপণ করে চাষীদের সর্বনাশ হয়েছে কৃষক। চারা রোপণের ২০ দিনের মধ্যেই শীষ বের হওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে।
জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে ধান উৎপাদনে নতুন এক আশার আলো দেখিয়েছিল এসিআই কোম্পানির বাজারজাতকৃত বর্ষালী ধানের বীজ। সেই আশা এখন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। বীজতলা থেকে চারা রোপণের মাত্র ২০ দিনের মধ্যেই শীষ বের হতে শুরু করেছে। চাষীরা জানান, স্বাভাবিক নিয়মে ধানের শীষ বের হওয়ার কথা ৫০ দিনের মাথায়। এতে গাছ গুছি ধরে। গ্যাস জমে এবং ফলন বাড়ে। কিন্তু অকাল শীষ ধরা ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফলে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছেন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, পাররামরামপুর ইউনিয়নের তারাটিয়া, পোড়াভিটা, উত্তর মোয়ামারী, বানিয়াপাড়া, কুমড়াকান্দী, ভাতখাওয়া কান্দাপাড়া, বানিয়াপাড়াসহ বাজারের আশপাশের এলাকার শতাধিক কৃষকের জমিতে চাষ করা বর্ষালী নামের এ নতুন জাতের ধান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যে জমিগুলোতে এসিআই বর্ষালী ধানের চারাবীজ রোপণ করা হয়েছে এগুলোতে রোপণের ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যেই শীষ বের হতে শুরু করছে। অপরদিকে পাশাপাশি যে জমিগুলোতে অন্যান্য জাতের ধান বীজের চারা রোপণ করা হয়েছে সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষকেরা জানান, মৌসুম শুরুর আগেই এ অঞ্চলে এসিআই কোম্পানির এই নতুন বীজ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। বলা হয় এটি স্বল্পমেয়াদি, অধিক ফলনশীল এবং বাজারের অন্য যেকোন বীজের চেয়ে মানসম্মত। এ ধরনের প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে কৃষকেরা ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বীজ কিনেছেন। অথচ বাজারে অন্য ধানের বীজ মিলছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়।
পোড়াভিটা গ্রামের কৃষক জুরান আলী বলেন, ১০০ শতক জমিতে আমি এই বর্ষালী বীজ রোপণ করেছি। প্রথমে চারা দেখে মনে হয়েছিল ফসল ভালই হবে। কিন্তু রোপণের ২০ দিন না যেতেই গাছে শীষ বের হতে শুরু করেছে। এতে ফলন তো কম হবেই, খরচও বেড়ে গেল দ্বিগুণ। এ বিষয়ে যে বীজ ব্যবসায়ের কাছ থেকে বীজ কিনেছি তাকে বিষয়টি অবহিত করলে তারা এই জমিগুলোতে অতিরিক্ত সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। তারা কিছুদিন পরপর আমাদের খোঁজখবর নিবেন বলে আশ্বস্ত করে চলে যান। আমরা যতই কীটনাশক ব্যবহার করতেছি কোনো আশা ভরসা কিছুই পাচ্ছি না। আমি অসুস্থ মানুষ। তিন বিঘা জমিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার টাকা ঋণ করে খরচ করেছি। এখন কিভাবে ঋণ শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না।
ফয়সুল্লাহ জানান, ২৫ শতক জমিতে চাষ করে তিনি ইতোমধ্যে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। কোম্পানির পরামর্শে বারবার সার আর কীটনাশক ব্যবহার করছি। কিন্তু তাতেও কোন সুফল মিলছে না। উল্টো খরচ বেড়েই চলেছে। আমরা একেবারেই দিশেহারা। কৃষক বারেক আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চারা লাগানোর সময় কোন সমস্যা দেখা যায়নি। গাছও সুন্দর হচ্ছিল। কিন্তু ২০ দিনেই শীষ বের হওয়ায় সব আশাই শেষ হয়ে গেল। কোম্পানি যদি ক্ষতির দায় না নেয়, তাহলে আমরা পথে বসব।
কৃষক ধনবাদশাহ বলেন, আমরা সব সময়ই নতুন জাতের বীজে আশার আলো দেখি। কিন্তু এই বীজ আমাদের সর্বনাশ করেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি। এখন ফলন না হলে ঘরে ভাত জুটবে না। কৃষক শামছুল হক বলেন, কোম্পানি লাভ করে চলে যাবে। কিন্তু আমরা কৃষকেরা সারাজীবন ক্ষতির বোঝা বয়ে বেড়াব। সরকার যদি ব্যবস্থা না নেয় তবে আমাদের আর ধান চাষ করার সাহস থাকবে না।
পোড়াভিটা গ্রামেই প্রায় ৪০ জন কৃষক ৮০ বিঘা জমির চাষ নিয়ে এই সমস্যায় পড়েছেন। পুরো ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম মিলে প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ধান এখন ঝুঁকির মুখে। স্থানীয় শাওয়ন বীজ ভাণ্ডার থেকে ৪০ কেজি, আরিফুল বীজ ভাণ্ডার থেকে ১৬০ কেজি এবং বিভিন্ন বীজ ভান্ডার থেকে প্রায় দুই টন বীজ বিক্রি হয়েছে। এই দুই টন বীজ থেকে প্রায় অধিকাংশ বীজের একই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় বীজ ব্যবসায়ীরা এসিআই কোম্পানির ডিলার ও কর্মকর্তাদের অবহিত করেছেন। কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার সাইদুর রহমান কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যাটি ‘পর্যবেক্ষণে’ রাখার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, যদি সমস্যার সমাধান না হয়, কোম্পানি কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেবে।
জানা যায়, এসিআই কোম্পানির ডিলার জাকির বীজ ভান্ডারের (সানন্দবাড়ী) মালিক মো. জাকির হোসেনের ডিলার পয়েন্ট থেকে এই মৌসুমে দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ রৌমারী, রাজিবপুর এই চারটি উপজেলায় বীজ সরবরাহ করেছে। এই ডিলার পয়েন্ট থেকে পাঁচ টন বর্ষালী ধান বীজ বিক্রি করেছে। সবমিলিয়ে পাররামরামপুর ইউনিয়নে প্রায় এক টন বর্ষালী ধান বীজ বিক্রি হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রতন মিয়া এ প্রতিবেদককে বলেন, এ ব্যাপারে এখনও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাননি। কৃষকেরা অভিযোগ করলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।