কর্তন হয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ | আমনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদনের পূর্বাভাস

::শাহাদাত বিপ্লব::

চলতি আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭২ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এরই মধ্যে এ মৌসুমে আবাদকৃত ধানের ৭৫ শতাংশ কাটা হয়েছে। বাড়তি ফলনের কারণে এবার আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াবে বলে ডিএইর এক নিয়মিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি আমন মৌসুমে চালের মোট উৎপাদন হবে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টন।

দেশে মোট চাল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ হয় আমন মৌসুমে। প্রত্যাশা অনুযায়ী আবাদ না হলেও ডিএইর হিসাব অনুযায়ী, এবার চালের উৎপাদন সংস্থাটির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াতে যাচ্ছে। আমন মৌসুমে মোট ৫৯ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল ডিএই। এর মধ্যে আবাদ হয়েছে ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে। আবার পোকামাকড় এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান। তবে এ ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আশঙ্কার চেয়ে কম হওয়ার পাশাপাশি হেক্টরপ্রতি ফলন ভালো হওয়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ডিএই কর্মকর্তারা।

ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত মোট ৪৩ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটা শেষ হওয়া জমিতে চালের উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৯৪ টন। ধান কাটা শেষ হওয়া জমির মধ্যে রোপা আমন আবাদ হয়েছে ৪২ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টরে। এখান থেকে চাল উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ টন। আর বোনা আমন আবাদ হয়েছে ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে। সেখান থেকে উৎপাদন হিসাব করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টন।

ধান কাটা শেষ হওয়া জমির গড় ফলন হিসাবে নিয়ে এবার আমন মৌসুমে মোট ১ কোটি ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার টন চাল উৎপাদন হতে পারে বলে জানিয়েছে ডিএই।

চাল উৎপাদনের প্রাথমিক পরিসংখ্যান ডিএই তৈরি করলেও চূড়ান্ত পরিসংখ্যান তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতি বছরই এ দুই তথ্যের মধ্যে দেখা যায় বিস্তর ব্যবধান। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উৎপাদনের তথ্যে তা দেখানো হয় আরো কম। খোদ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, উৎপাদনের সঠিক তথ্যের অভাব যথাযথ নীতি গ্রহণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে এবার সার্বিকভাবে আমন মৌসুমে ধানের ফলন তুলনামূলক ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকসহ খাতসংশ্লিষ্টদের অনেকেই। দেশে চালের সরবরাহ ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রে রয়েছে নওগাঁসহ রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলা। এখানকার কৃষকরাও জানিয়েছেন, এবার আমন মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হয়েছে অন্যবারের চেয়ে তুলনামূলক বেশি।

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চান্দাশ ইউনিয়নের চকপন্দেরপুর গ্রামের কৃষক রেজাউল মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেড় বিঘা জমিতে স্বর্ণা-৫ জাতের আমন ধান রোপণ করেছিলাম। ধান কাটা-মাড়াইসহ খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। ৩০ মণ ধান ফলন পেয়েছি। স্থানীয় বাজারে এ ধান ১ হাজার ১০০ টাকা মণ দরে কেনা-বেচা হচ্ছে। এবার ধান বিক্রি করে কমপক্ষে ২১ হাজার টাকা লাভ হবে। সার্বিকভাবে ধানের ফলন ভালো হয়েছে।’

তবে বিশেষ কয়েকটি জাতের ধান আবাদ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এখানকার কয়েকজন কৃষক। সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী গ্রামের কৃষক আহসান হাবীব বলেন, ‘দেড় বিঘা জমিতে ব্রিধান-৪৯ জাতের ধান রোপণ করেছিলাম। ধান পরিপক্ব হওয়ার পর আকস্মিক বৃষ্টির ধাক্কা সামলাতে পারেনি জাতটি। ফলে মুনাফা বা উৎপাদন কোনোটিই আশানুরূপ হয়নি।’

জেলাটির সার্বিক আবাদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখানে এবার ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ করা হয়েছিল। এর ৯৫ শতাংশ ধান এরই মধ্যে কাটা ও মাড়াই শেষ করেছেন কৃষকরা। প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ২৯ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতি হেক্টরে ৩ দশমিক ৩৫ টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর কমপক্ষে ১৫ হাজার টন বেশি চাল উৎপাদিত হবে বলে আমরা আশাবাদী।’

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহেও এবার ধানের ফলন হয়েছে তুলনামূলক বেশি। আবার বৃষ্টির কারণে প্রত্যাশামাফিক না হলেও এবার ধানের দাম ভালো পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

ঝিনাইদহের সদর উপজেলার কৃষক সোহেল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বছর আমন ধান ভালো হয়েছে। এক বিঘা (৪৬ শতক) জমিতে গুটি স্বর্ণা আবাদ করেছিলাম। প্রায় ২৮ মণ ধান হয়েছে। ১ হাজার ১২০ টাকা প্রতি মণ ধান বিক্রি করেছি। তবে আগে বাজার ভালো ছিল। বৃষ্টি হওয়ায় দাম কমে যায়। তারপরও তুলনামূলকভাবে ভালো দাম পেয়েছি।’

একই চিত্র দেখা গেছে উত্তরবঙ্গের বগুড়ায়ও। এখানে এবার আমন ধানের আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে। সেখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ছয় লাখ টন।

বগুড়া সদর উপজেলার কৃষক খোকন হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এবার সার ও কীটনাশকের দাম বেশি ছিল। প্রতি বিঘায় ১৮ মণ ধান পেয়েছি। প্রতি মণ ধান ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেছি। যদি প্রতি মণ ১ হাজার ৫০০ টাকা হতো তাহলে ভালো হতো।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান বলেন, ‘আমনে এ বছর ভালো ফলন হয়েছে। কৃষকরা প্রতি বিঘায় প্রায় ১৮ মণ চাল পেয়েছেন। আবার বাজারেও ধানের দাম বেশি ছিল।’

গত মাসে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি। এতে প্রায় দুই লাখ হেক্টর আমন ধানের জমি আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমির ধান। আবার মিধিলির ক্ষতির রেশ কাটতে না কাটতেই চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় মিগজাউম ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় ভারি বৃষ্টিপাতে কিছু আমন জমির ধান আক্রান্ত হয়।

আবার দেশের কোনো কোনো স্থানে পোকামাকড়ের আক্রমণে আমন ধানের ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছেন কৃষকরা। নেত্রকোনার কয়েকটি উপজেলায় শীষকাটা লেদা পোকার আক্রমণে ধান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সদর উপজেলার মেদনী ইউনিয়নের টেঙ্গা গ্রামের কৃষক আবু চান মিয়া বলেন, ‘এ বছর আমনের ফলন হয়েছে ভালো, ধানও কাটার পথে। কিন্তু লেদা পোকার আক্রমণের কারণে কাঙ্ক্ষিত ফলন ঘরে তোলা যায়নি। মাঠে উঠতি ফসলের ধানের শীষ কেটে ফেলে দিয়েছে লেদা পোকা। আক্রমণ ঠেকাতে ওষুধ প্রয়োগ কোনো কাজে আসেনি।’

চালের উৎপাদন ভালো হওয়ার বিষয়টিকে বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত মৌসুমগুলোয় নিঃসন্দেহে চালের উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে। এ বছর আমন মৌসুমেও ভালো উৎপাদন হয়েছে। দেশে চালের কোনো সংকট নেই। বড় কোনো দুর্যোগ না হলে আর চাল আমদানি করতে হবে না। সরকার মূলত চাল সংগ্রহ কম হলে আমদানি করে থাকে। সরকারিভাবে মজুদ সক্ষমতা আগের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এটাকে আরো বাড়াতে হবে। কৃষক ধান বিক্রি করে ভালো দাম পাচ্ছে। এটা ধরে রাখতে হবে। তাহলে সরকারিভাবে চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। শুধু প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। যাতে কোনো অবস্থাতেই তা বিঘ্নিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। সেজন্য সবাইকে সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে হবে। তাহলেই দেশের খাদ্য পরিস্থিতিতে বিশেষ করে চালে একটি স্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করবে।’

এর পরও চালের বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় আশঙ্কা তৈরি করছে উৎপাদন নিয়ে যথাযথ তথ্যের অভাব। গত অর্থবছরে ৫৯ লাখ ২ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৭০ লাখ টন চাল উৎপাদন হওয়ার প্রাথমিক তথ্য দিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এরপর বিবিএস থেকে প্রকাশিত চূড়ান্ত তথ্যে দেখা যায়, ৫৭ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ১ কোটি ৫৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ ডিএই ও বিবিএসের তথ্যে গরমিল ১৬ লাখ টনের বেশি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে গত বছরের আমন মৌসুমে ১ কোটি ৪৬ লাখ টন উৎপাদন হওয়ার পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছিল।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতি বছরই উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে সংস্থাগুলো ভিন্ন তথ্য দেয়। এ বছর যেহেতু সার্বিকভাবে সংকট রয়েছে, তাই বিবিএস থেকে বিশেষভাবে চালের উৎপাদন ও মজুদ নিয়ে একটি জরিপ করা যেতে পারে। তাহলে চিত্র বোঝা যাবে। আমন এখন উঠবে। তাই আপাতত চালের প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না। তবে পরিসংখ্যানে দুর্বলতা থাকলে মার্চ নাগাদ সংকট দেখা দিতে পারে। তখন সংকট হলে আবার দাম বেড়ে যেতে পারে বা বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।’

২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়। তবে চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কোনো চাল আমদানি হয়নি। গত অক্টোবরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) সভায় আমন মৌসুমের চাল বাজারে আসা পর্যন্ত চাল আমদানি না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ বছর চাল আমদানি না হলেও চালের বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল। গত মাসে মোটা ও মাঝারি আকারের চালের দাম কিছুটা বাড়লেও আমনের চাল বাজারে উঠতে শুরু করলে দাম কিছুটা কমে আসে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন সরকারিভাবে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে। এর পাশাপাশি চলছে আমন সংগ্রহ। চলতি আমন মৌসুমে দুই লাখ টন ধান, চার লাখ টন সেদ্ধ চাল ও এক লাখ টন আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরপর ১২ ডিসেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আরো দুই লাখ টন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে দেড় লাখ টন সেদ্ধ ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল। এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টন চাল সংগ্রহ হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এটিএম সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হয় তা চাহিদার চেয়ে বেশি। কিন্তু বাজারে ভারসাম্য আনার জন্য প্রতি বছর কিছু চাল আমদানি করতে হয়। কারণ তা না হলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেবে। এ বছর আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় বা অন্যান্য সমস্যা থাকলেও তা খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।’ সূত্র:বণিক বার্তা।