পহেলা বৈশাখ পালন এবং দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষা

:সৈয়দ ফারুক হোসেন :: বৈশাখের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। বাঙালির এই বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির বিজয়। এই সাংস্কৃতিক বিজয়ের ফল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির এই সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখে নতুনকে গ্রহণ করার, পুরোনোকে মুছে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা গ্রহণ করা হয় উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশে এই নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে সর্বজনীন উৎসবে।

নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপলব্ধি এবং এর নিরন্তর চর্চা করা যে কোনো জাতির জন্যই গৌরবের। এ গৌরব বাঙালি জাতিরও রয়েছে। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আমাদের ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যের ধারকবাহক বাঙালি। এই বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ ফুটে ওঠে বাংলা নববর্ষের দিন। বাংলা নববর্ষ বাঙালির সমগ্র সত্তা, অস্তিত্ব ও অনুভবের সঙ্গে মিশে আছে। এটা বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল দিক।

বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখ আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এ জাতি তার দেশকে ভালোবাসে, ভালোবাসে তার সংস্কৃতিকে। অসাস্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে নববর্ষ বরণ বাঙালি জাতিসত্তাকে উজ্জ্বল করে। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও এ জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, রক্ষা করবে প্রাণের চেয়ে প্রিয় এ ভাষা, হাজার বছরের সংস্কৃতি। আবহমানকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হচ্ছে বর্ষবরণের এ উৎসব। হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলিত বাঙালি জাতির একান্ত এ উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে সবাই।

এপ্রিল মাসে আমরা বাংলাদেশীরা একটি উৎসব করে থাকি, তা হলো ১৪ই এপ্রিল। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালন করা। পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ মাছের ঠিক কী সম্পর্ক বা কবে থেকে বৈশাখের প্রথম দিনে পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশের প্রচলন হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এ প্রথাটা এখন আমাদের ভেতর গেঁথে গেছে। পহেলা বৈশাখের আনন্দ ইলিশ জোগাড় করতে না পারার জন্য মাটি হয়ে যাবে এমনটি হতে দেওয়া যায় না। আমাদের ভাবখানা এমন যে, এদিন ইলিশ খেতে না পারলে সারা বছর ইলিশ খাওয়া যাবে না। তাই যেভাবেই হোক না কেন, একটা ইলিশ জোগাড় করা চাই, তা সে যত দামই হোক না কেন।

বাংলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে নতুন ফসলকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের সূচনা, কালক্রমে সেটাই পরিণত হয়েছে নববর্ষ বরণ উৎসবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়েছে, বহুবার বদল ঘটেছে শাসকের, কিন্তু বৈশাখ চিরন্তন উৎসবের রূপে জড়িয়ে রেখেছে বাংলার জনপদকে। শহরে বৈশাখ যে ব্যাপক উৎসবের উপলক্ষ্য নিয়ে আসে গ্রামীণ জীবনে তার আমেজ ভিন্ন। নগরজীবনে এই দিন যেমন পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়, তেমনি যুক্ত হয় নতুন কাপড় পরার আয়োজনও। গ্রামবাংলায় সকালবেলা দই-চিড়া দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করার রেওয়াজ আছে। ব্যবসায়ীরা দোকানে দোকানে হালখাতার আনুষ্ঠানিকতায় মিষ্টি দিয়ে তাদের ক্রেতাদের স্বাগত জানান। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে চৈত্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় বিজু উৎসব।

পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। প্রতিটি বাঙালি দিনটিকে উদযাপন করে উৎসবের আমেজে। নতুন পোশাক পরে সবাই মিলিত হন সাংস্কৃতিক আয়োজনে। ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণের যে প্রভাতি অনুষ্ঠান শুরু করেছিল তা আজ বিশ্ব জুড়ে বর্ষবরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশজ সংস্কৃতির অনেক ভাল দিক আছে। সামাজিক শিষ্টাচার, সৌহার্দ্য, জনকল্যাণ, মানবপ্রেম ইত্যাদি সকল মূল্যবোধ আমরা সমাজ থেকে তুলে দিচ্ছি। পক্ষান্তরে দেশীয় সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। বেপর্দা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদকতা ও অপরাধ একসূত্রে বাধা। যুবক-যুবতীদেরকে অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার সুযোগ দিবেন, অথচ তারা অশ্লীলতা, ব্যভিচার, মাদকতা ও অপরাধের মধ্যে যাবে না, এরূপ চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য পালন করতে গিয়ে কোনো কুসংস্কারের আশ্রয়ে যাওয়া চলবে না।

পহেলা বৈশাখ আসলে বাঙালির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎসব আরও আছে; কিন্তু পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসব আর নেই। যেখানে বাঙালির প্রাণই মূল কথা। জাতিভেদ, বর্ণভেদ এখানে মাথা তুলে দাঁড়ায় না। সবাই একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। বাংলা নববর্ষ আমাদের উদার হতে শেখায়। নতুন বছর আমাদের ভালো কাটবে এই আশায় আনন্দ নিয়ে বের হই। সামনের দিনগুলো কেমন হবে এটা কেউ বলতে পারে না; কিন্তু পহেলা বৈশাখ পালনের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে। এদিন লাখ টাকা মণ ইলিশ খেতে পারলাম কিনা তার থেকে বড় কথা পহেলা বৈশাখ বা নতুন বছরকে কতটুকু বরণ করতে পেরেছি।

বিদেশি সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষায় দেশীয় সংস্কৃতিকে আমাদের রক্ষা করতে হবে কারণ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য এবং আমাদের নিজস্ব ধারক এবং বাহক। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে গ্রাস করছে। এ আকাশ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে। আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক সংগঠন বিদেশি সংস্কৃতির পাশাপাশি খ্যাতিমান শিল্পীদের এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। তবে আমাদের এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের দীর্ঘকালের সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের লালনকে জোরদার করতে হবে। এক কথায় আমরা এখন নামে বাঙালি, কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে আজ আমরা পুরোপুরি পরিচিত নয়। এ কারণে দেশীয় সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। সবাইকে দেশীয় সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। শিশু-কিশোরদের দেশীয় সংস্কৃতিতে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশ আমাদের, ঐতিহ্য আমাদের, তাই দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব সবার।

অপসংস্কৃতি বা ভিনদেশী কুসংস্কৃতি যেন আমাদের মাঝে প্রবেশ করে দেশীয় সংস্কৃতিকে আঘাত না হানতে পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। দেশীয় ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং তা তুলে ধরা দরকার। সব ধর্মের মানুষের মধ্যে দেশিয় সংস্কৃতির ধারা অব্যহত রাখতে হবে, অন্যথায় দেশে বিদ্যমান শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ পূর্ণতা পাবে না। সংস্কৃতি একটি জাতি ও রাষ্ট্রের দর্পণস্বরূপ। এই সংস্কৃতির মাধ্যমেই একটি জাতি ও রাষ্ট্র বিশ্বদরবারে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমরা নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশি সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি।

সমাজসভ্যতার অনেক বিকাশ ঘটেছে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্র অনেক প্রসারিত হয়েছে। অজানাকে জানার অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞান তথা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা অবাধ তথ্যপ্রবাহের বদৌলতে। বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব সাফল্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অনাবিল প্রশান্তি যেমন এনে দিয়েছে, তেমনি এই প্রযুক্তি মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো এবং নৈতিকতাকে দিনদিন অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে দিচ্ছে। বিজাতীয় অপসংস্কৃতির তাণ্ডবলীলায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উদ্দাম ভোগবিলাসিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার জন্ম দেয়। নতুন সংস্কৃতির উন্মত্ততায় সে সময় যে অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল, সেগুলো বর্জন করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সদর্থক ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সমাজ সংস্কারক বাঙালি মনীষীরা। আমাদের নতুন প্রজন্মসহ সব মানুষকে নিজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্বন্ধে জানতে হবে, লালন করতে শিখতে হবে, অপরকে জানাতে ও শেখাতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন এর ব্যাপক প্রচার ও প্রসার।

ভোগবাদী নগর সংস্কৃতির প্রবণতা ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আগ্রাসী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে লোকসংস্কৃতিকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ঐতিহ্যের শেকড় থেকে পুষ্টি সংগ্রহের মধ্য দিয়ে জাতিগত বিকাশের পথ খুঁজে বের করতে হবে এবং সব অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতিচর্চা যেন আজ একেবারেই কমে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণাই থাকবে না। ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া ও রুচিবোধে আজ অনেকের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আমরা বাঙালি অথচ বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে আজ আমরা অনেকেই উদাসীন। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান না দেখে অনেকে আজ বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটক সিনেমা বা সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। শিশুদেরও আজ এমনটা দেখানো হচ্ছে। দেশীয় পোশাক যেন আজ অনেকের কাছে অচেনা। বিদেশী সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই আজ দেশীয় পেশাক পরিহার করে বিদেশী পোশাক পরিধানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে এমন কিছু অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, যা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পশ্চিমা ও ভারতীয় সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান আধিপত্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র, ভার্চুয়াল মিডিয়া, সংগীত এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজাতীয় সংস্কৃতির আধিপত্য প্রচার করা হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশের সিরিয়ালের ভয়াল থাবা যেন পুরো দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। টিভি সিরিয়ালের বিষয়বস্তুগুলো মনের অজান্তেই তাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এর ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে পরিবারগুলোর ভেতরে পারিবারিক সংঘাত অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে কোরিয়ান সংস্কৃতির অনেক ভক্ত নাটক বা মিউজিক ভিডিওতে দেখা পছন্দের তারকাকে বাস্তব জীবনে অনুকরণ করে থাকে। তরুণদের বড় একটা অংশ বর্তমানে তাদের মতো করে জীবনধারায়ও পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। ফলে বাংলাদেশে কোরিয়ান প্রসাধনী ও সৌন্দর্য পণ্যগুলোর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোরিয়ান সংস্কৃতি নতুন একটি পরিবেশের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নেয়, স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে কোরিয়ান তরঙ্গ মিশে এমন একটি হাইব্রিড (মিশ্র) সংস্কৃতি গড়ে তুলছে। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে তা যদি হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, প্রশ্রয় দেওয়া হয় অপসংস্কৃতিকে আর এর বিরূপ প্রভাবে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় দেশের তরুণ প্রজন্ম। তবে তা কোনো মতেই মেনে নেওয়া যায় না।

ভালো কিছু গ্রহণ করতে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু অবাধে অপসংস্কৃতি প্রবেশে সব দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়ার পক্ষেও কেউই সায় দেবে না। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের ফলে আমাদের সংস্কৃতির মূল প্রাণ লোকসংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। আমরা বিদেশের সঙ্গে সংস্কৃতির আদান-প্রদানের বিরুদ্ধে নই, কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে তা করার পক্ষে। একটি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য সাংস্কৃতিকভাবে আঘাত হানাই যথেষ্ট। আমাদের বিভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক উৎসবগুলোতেও বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সা¤্রাজ্যবাদিত্তে¡রই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, এখনো পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে। দেশীয় সুরসঙ্গীত আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

আমাদের রুচিবোধে কেন ভিনদেশী সংস্কৃতি প্রবেশ করবে? তরুণ তরুণীরা আজ দেশীয় সংস্কৃতি ছেড়ে বিদেশী ধ্যানধারণাকে অধিক প্রাধান্য দিচ্ছে। এমনকি বাংলার পুরাতন ঐতিহ্যে ঘেরা দর্শনীয় স্থানে না গিয়ে অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চলে যায় ভিনদেশী ঐতিহ্য দেখতে। এমনকি বাঙালি হয়েও অনেকে আজ আমরা বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার করছি না। ভাষা ব্যবহারেও বিদেশমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও আজ বিদেশমুখী মনোভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যে ডিগ্রি বা সার্টিফিকেটের মান দেশে ও বিদেশে একই অথচ সেই ডিগ্রি অর্জনের জন্য অনেকে বেহুদা বিদেশমুখী হচ্ছে। এতে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার মান অনেকটা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সঙ্গীত বা গানেও আজ ভিনদেশী প্রভাব পড়ছে। তরুণ-যুবকেরা আজ ভিনদেশী সঙ্গীতে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে। মনে পড়ে যায় মুরব্বিদের মুখে বা দাদা দাদির মুখে শোনা বাউল, মুশির্দী, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারিসারি গানের কথা। এ যেন এখন শুধু অতীত স্মৃতি। রঙঢঙে করা এসব গান আমাদের পুরাতন ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজ দেশীয় গান ছেড়ে সবাই বিদেশী গানের পাগল। এমনকি আচার আচরণে আজ ভিনদেশী প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় আজ সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। বিদেশী ধ্যান-ধারণা মন প্রাণ থেকে মুছে ফেলে দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে এবং সবাইকে উৎসাহী করতে হবে। দেশীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণে সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যমগুলোকেও আরো সচেতন হতে হবে যাতে বিদেশী সংস্কৃতির কোনো প্রভাব দেশীয় মিডিয়ায় প্রবেশ না করতে পারে। আজ দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের মধ্যে যাদের কাছে অচেনা অথচ ভিনদেশী টিভি চ্যানেল সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা খুবই বেশি। দেশীয় খাবারগুলোর চেয়ে বিদেশী খাবারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। বাঙালি ঐতিহ্যের বাহক পুরনো দিনের সেই পিঠাগুলো আজ আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে প্রায়ই অচেনা।

পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করেছিল। এতে হাজার হাজার বাঙালি যোগ দিয়েছিল। এই দিন বাংলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়। লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসে। নববর্ষ মানে নবজাগরণ। বাঙালির পুরনো ঐতিহ্যকে শহরে থেকেই স্মরণ করি অথবা ঐতিহ্যের কাছে ফিরে যাই। বাঙালি জাতি গানে-কবিতায়, নানা লোকাচারে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দূর অতীত থেকেই বয়ে চলেছে নববর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সম্রাট আকবরের শাসনামলে কৃষিনির্ভর বাংলায় বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন চালু হয়েছিল, নানা বিবর্তনে তা আজো বহমান। এ দেশের বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে বাংলা নববর্ষ বহুকাল ধরে বরণীয়। চৈত্রসংক্রান্তির নানা লোকাচার আর নববর্ষ বরণে কৃষিজীবী সমাজের বিচিত্র আয়োজন লোকায়ত উৎসব হিসেবেও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও বৈশাখের গুরুত্ব যথেষ্ট।

লেখক : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর