বেবিকর্নে লাভের ওপর ডাবল লাভ

বেবিকর্নের ক্ষেত।

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

বেবিকর্ন আবাদে স্বল্প পুঁজিতে লাভ বেশি। একখন্ড জমি থেকে একাধারে ফসল, গো-খাদ্য হিসাবে সবুজ গাছ, আবাদি জমির ফাঁকে ফাঁকে আলু, বেগুন ও ডাল জাতীয় বিভিন্ন ফসল বুনে পাওয়া যায় অতিরিক্ত ফসল। যে কারণে বেবিকর্ন আবাদে লাভের ওপর ডাবল লাভ পাওয়া যায়। কথাগুলো বলছিলেন শেরপুর সদর উপজেলার কুলুরচর গ্রামের কৃষক আমিনউদ্দীন।

তাকে দেখে চরাঞ্চলের এখন অনেক কৃষক পুষ্টিকর খাবার বেবিকর্ন চাষে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফলে আগামী দিনে এই পণ্যটির আমদানি নির্ভরতা কমবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে বেবিকর্ন আবাদে আগ্রহী চাষিদের সকল প্রকার সহযোগিতা করা হবে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, শেরপুরের চরাঞ্চলের মাটিতে এখন হেলদোল করে হাসছে ভুট্টা প্রজাতির ফসল বেবিকর্ন। খড়া সহিষ্ণু এ ফসলটি উৎপাদনে স্বল্প পুঁজি ব্যয়ে লাভ বেশি পাওয়া যায়। তাই তারা ঝুঁকছেন বেবিকর্ন চাষে। পুষ্টিকর খাবার হিসাবে শিশুদের জন্য ও অভিজাত চাইনিজ রেস্তোরায় এটি ব্যবহার হয়। এক একর জমিতে বেবিকর্ন চাষে খরচ পড়ে মাত্র ৪০ হাজার টাকা। আর ফসল বিক্রি করে পাওয়া যায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। পাশাপাশি গো-খাদ্য হিসাবে পাওয়া যায় ২২ টন সবুজ গাছ। এছাড়া বেবিকর্ন গাছের ফাঁকে ফাঁকে সাথী বা বোনাস ফসল হিসাবে আলু, বেগুন, লাল শাক, পালং শাক ও ডাল জাতীয় ফসল আবাদ করে পাওয়া যায় অতিরিক্ত ফসল।

কৃষক হাসান আলী, মজিবর ও সিরাজ মিয়া বলেন, ধানের তুলনায় বেবিকর্ন চাষে পানি কম লাগে। পোকার উপদ্রব এবং রোগের সংক্রমণ নাই বললেই চলে। আর বপনের সময় থেকে সর্বোচ্চ ১০০ দিনের মধ্যে বেবিকর্ন ঘরে তোলা যায়। গাছ সবুজ থাকা অবস্থায় বেবিকর্ন সংগ্রহ করা হয় তাই এর কান্ড ও পাতা গো-খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এই গো-খাদ্য বিশেষ পন্থায় ৩-৫ মাস সংরক্ষণ করা সম্ভব। এতে চরবাসীদের গো-খাদ্যের চাহিদা পূরণ হবে।

চাষি বজলুর রহমান দুলাল, বাক্কী বিল্লাহ জানালেন, বেবিকর্ণের সারির মাঝে ৭৫ সেন্টিমিটার সিড টু সিড দূরত্ব থাকে ২৫ সেন্টিমিটার। দুই সারির মাঝে ওই ৭৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে এক সারি কিংবা দুই সারি করে গোল আলু লাগিয়ে দেওয়া যায়। গোল আলুর বদলে লালশাক, পালংশাকও চাষ করা যায়।

বেবিকর্নের ক্ষেত।

গত ৩ বছর ধরে চরাঞ্চলের মাটিতে পরীক্ষামূলকভাবে বেবিকর্ন আবাদ করে সাফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি’র শিক্ষার্থী ও বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ প্রাপ্ত শেরপুর জমশেদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক পার্থ সারথী কর। তিনি জানান, এদেশের মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ০.৭২ মিলিয়ন হেক্টর জমি চরাঞ্চল। আর চরাঞ্চলের বেশিরভাগ বেলে মাটি। এ মাটির পানিধারণ ক্ষমতা খুব কম। এ ধরনের জমিতে রয়েছে জৈব পদার্থ ও উর্বরতার ঘাটতি। যে কারণে চরাঞ্চলে ফসলের উৎপাদনও কম। চরাঞ্চলের প্রধান ক্রপিং প্যাটার্ন (ফসলবিন্যাস) হলো বোরো ধান ও পতিত আমন ধান। আমন ধান মৌসুম আকস্মিক বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আবার পানির ঘাটতির কারণে বোরো ধানের উৎপাদনও লাভজনক নয়। তবুও কৃষকরা তাদের খাদ্য ও গো-খাদ্যের জন্য বোরো ধানের চাষ করতে বাধ্য হয়।

তিনি বলেন, বেবিকর্ন একটি স্বল্প মেয়াদী ফসল। এটি অর্থকরী ফসল হিসাবে চাষ করা যেতে পারে। অভিজাত চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে বেবিকর্ন স্যুপ একটি জনপ্রিয় খাবার। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে বেবিকর্ন অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য। আর এ খাদ্য পণ্যটি চীন ও ভারত থেকে আমাদের দেশে আমদানি করতে হয়। এখন এ দেশ থেকে এ পণ্যটি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের এক জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক সহকারী জানান, ৭৫ শতাংশ রাসায়নিক সার আর ২৫ শতাংশ জৈব সার প্রয়োগে বেবিকর্নে সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়া গেছে।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের বিন্স প্রজেক্টের কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, বেবিকর্নের আবাদি জমিতে ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা যায়। এতে করে কৃষকরা একই জমি থেকে একই সময়ে বেবিকর্ন, গো-খাদ্য এবং ডাল জাতীয় ফসল অর্থাৎ মোট তিনটি ফসল পেতে পারেন। যেহেতু চরের জমি প্রায় অনূর্বর, ডাল জাতীয় ফসল বায়ুমন্ডলীয় নাইট্রোজেন সরাসরি সংগ্রহ করে এবং মাটিতে ছেড়ে দেয়, ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, ডাল জাতীয় ফসল মাটির ক্ষয় হ্রাস করে, আগাছা দমন করে, কীটপতঙ্গ ও রোগ হ্রাস করে এবং জমি ব্যবহারের দক্ষতা উন্নত করে। সর্বোপরি চরাঞ্চলে টেকসই কৃষির সৃষ্টি হবে। তাই তিনি পার্শ্ববর্তী জামালপুর জেলার চরাঞ্চলের জমিতেও বেবিকর্ন চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করবেন বলে জানান।

বেবিকর্নের ক্ষেত।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বেবিকর্ন গবেষক প্রফেসর ড. আব্দুল কাদের বলেন, ধান চাষ করলে ক্ষেতে প্রতিদিন দুইবার পানি দিতে হয়, সেক্ষেত্রে বেবিকর্ন চাষে মৌসুমে মাত্র ৩ বার পানি দিলেই চলে। তাই চরাঞ্চলের যেসব পতিত জমি রয়েছে বা অন্য ফসল করে কৃষক কোন লাভের মুখ দেখতে পায়না তাদের জন্য বেবিকর্ন আদর্শ আবাদ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজারে বেবিকর্নের চাহিদা তৈরি হয়েই আছে। এখন দেশের চেইনশপগুলোর সাথে কৃষকদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে কাজ করছেন তিনি।

অন্যদিকে বেবিকর্ন আবাদে আগ্রহী চাষিদের সকল প্রকার পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহিত কুমার দে।