দিল্লির গল্প-১ : দিল্লির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও কিছু কথা

দিল্লি জামে মসজিদের সামনে লেখক।

॥ জাহিদুর রহমান উজ্জল ॥

কিছুদিন আগে দিল্লি গিয়েছিলাম। এই রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেখে আমি অবাক হয়েছি। হিন্দু মুসলমান দুই ধর্মের মানুষের সহঅবস্থান সত্যিই একটি সম্প্রীতির দেশ হিসাবে ভারতকে মানায়।

কিন্তু কয়েক দিনের সংহিংসতা ও দাঙ্গায় আমাকে হতাশ করেছে। ভাবতে পাচ্ছিনা এক বৃন্তে দুটি ফুলের মধ্যে কি করে বিবাদ শুরু হলো।

চেন্নাই থেকে ফ্লাইটে দিল্লি পৌছালাম। আমার হোটেলটি ছিল পাহাড়গঞ্জে। সেটি দিল্লি সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের ঠিক সামনে। হোটেলটির নাম ‘স্টেশন ভিউ’।

হোটেলে গিয়ে সব রেখে খাওয়ার জন্য বাইরে বের হলাম। প্রথমবার দিল্লিতে। তাই খাবার নিয়ে একটু দুঃচিন্তা ছিলো। কারণ চীন সফরে গিয়ে খাবার নিয়ে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। যাক সে কথা।

খাবার হোটেল খোঁজার জন্য বাইরে আসতেই হোটেলবয় জানিয়ে দিল এই পাহাড়গঞ্জেই ভালো মুসলিম হোটেল রয়েছে। সারিসারি রিকশা, ইশারায় একজনকে ডাকলে বাংলায় জবাব এলো; কই যাবেন? বাংলা ভাষা শুনে একটু অবাক হলাম। কাছে গিয়ে ভালো মানের মুসলিম হোটেলের কথা বলতেই সে রিকশায় উঠতে বললো। রিকশায় চেপে বসতেই প্যাডেলে পা চালাতে চালাতে জানালো দারুণ সব কথা।

রমিজ উদ্দিন তার নাম পশ্চিম্ববঙ্গে বাড়ি। দিল্লিতে আছেন অনেক বছর ধরে। তাকে প্রশ্ন করলাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে দিল্লিতে কেন? স্পষ্ট জানিয়ে দিলো এখানে নিরাপত্তা বেশি। মুসলমানদের জন্য বেশি নিরাপদ। এখানে ধর্ম নিয়ে কোন বিবাদ হয় না। ওরা তো আমাদের উপকার করে। কালতো দিপালী উৎসব। দেখেন ওদের উৎসবে আমরা আনন্দ করবো আমাদের ঈদে ওরা আনন্দ করে। তার কথায় বুঝা গেল ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। সামনে যেতে যেতে ভাবলাম আসলেই তো দিল্লি শাসন করেছেন মুসলমান শাসকরা। দিল্লি কেন্দ্রিক সর্ব ভারতীয় শাসন: সম্রাট মোহাম্মদ ঘোরী আমল থেকে শেষ মুগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর- ১১৯৩-১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় হিন্দুস্তান একক কোনো মুসলিম রাজবংশের দ্বারা পরিচালিত হয় নি। বরং একাধিক মুসলিম রাজবংশ এই দীর্ঘ সময় হিন্দুস্তানকে শাসন করেছেন। তাই দিল্লির ইতিহাসের সাথে মুসলিমরা অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। তাই এটাই তো নিরাপদ তাদের জন্য।

চোখেও পড়লোও তাই, দোকানের পর দোকান চালাচ্ছেন মুসলিমরা। ব্যস্ত এই নগরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সুমধুর আজানের সুরধ্বনি ভেসে আসে। পরদিন ‘দিপালী’ উৎসব সারা শহরে চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা, আতসঁবাজির শব্দে কানে তুলো দেওয়ার অবস্থা; এর মধ্যেই দলে দলে লোক টুপি মাথায় নামাজে যাচ্ছে। এই সম্প্রীতির বন্ধনে আমার মন ভরে গেলো। দোকানে কেনাকাটা করার জন্য গিয়ে দোকানী মিয়া সালেহ আহম্মেদ কথায় কথায় হিন্দি তে জানালো বাপ দাদার কাল থেকে তারা দিল্লিতে রয়েছেন। কোনদিন দাঙ্গা দেখেননি। তিনি জানালেন, ওদের ও আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। সবাই মিলেমিশে রয়েছি। তার কথায় আবারো প্রমাণ পেলাম দিল্লি মুসলিমদের জন্য বড়ই নিরাপদ।

পরদিন দিল্লির ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে বের হলাম। প্রথম তালিকা ছিল দিল্লির জামে মসজিদ। এই মসজিদ দেখলাম। এতোদিনের মসজিদটি কি সুন্দরভাবে রয়েছে। হাজার হাজার দর্শনার্থী এই মসজিদটি দেখতে আসে। আমি সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠে মসজিদটি সম্পূর্ণ দেখলাম।

দিল্লি জামে মসজিদ (মসজিদ-ই জাহান-নুমা) ভারতের নয়াদিল্লির ঐতিহািসক লালকেল্লার অপরপাশে অবস্থিত। ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর প্রাচীন সুন্দরতম ও ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম এই সুবিশাল জামে মসজিদ মোগল সম্রাট শাহজাহান (১৬৪৪-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে) তৈরি করেছিলেন। লাল বেলে পাথর ও সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এই মসজিদ নির্মাণ করতে তৎকালীন খরচ গুনতে হয়েছে ১ মিলিয়ন রুপি।

এই মসজিদে ৫ হাজার শ্রমিক প্রায় ১২ বছর কাজ করেন। মসজিদের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে একটি করে তিনটি সুবিশাল প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই দ্বারগুলো দিয়ে মসজিদে উঠতে গেলে আপনাকে যথাক্রমে ৩৯, ৩৩ ও ৩৫টি করে সিঁড়ি মাড়াতে হবে। মাটি থেকে মসজিদের ভিটের উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মসজিদের তিনটি গুম্বুজ ও ১৩৫ ফুট উঁচু দু’টি মিনার রয়েছে। মিনারে লাল বেলে পাথর এবং সাদা মার্বেল দিয়ে লম্বালম্বিভাবে ডোরাকাটা কারুকাজ করা হয়েছে। মসজিদদের মেঝেতে জায়নামাযের ন্যায় কালো মার্বেল পাথর দিয়ে ব্লক তৈরি করা হয়েছে। পাথর দিয়ে অলংকৃত এরকম ব্লক মসজিদের মধে ৮৯৯টি। মসজিদের ভিতর ও বাহিরের আঙিনায় এক সাথে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ নামায আদায় করতে পারেন।

এই মসজিদ (২৩ জুলাই ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) সম্রাটের আমন্ত্রণে বোখারা থেকে আগত এক শায়খের মাধ্যমে উদ্বোধন হয়। এখন পর্যন্ত এই শায়খের বংশধরদের মধ্য থেকে একজন ধারাবাহিকভাবে মসজিদের ইমাম হয়ে আসছেন।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের পর ব্রিটিশ সরকার মসজিদ ক্রোক করে সেখানে তাদের সৈন্য মোতায়েন করে। এমনকি ঈমানদার মুমিনের মনে আঘাত দেওয়ার জন্য এই ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংসের পায়তারা করে। কিন্তু মুমিন মুসলমানের বাধার মুখে তাদের চক্রান্ত সফল হয়নি।

মসজিদের উত্তর পাশে একটি ভবনে রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু-আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) এর পবিত্র স্মৃতি চিহ্ন ও হরিণের চামড়ার উপর লিখা পবিত্র কোরআন শরীফের একটি অনুলিপি রয়েছে। (সূত্র: উইকিপিডিয়া)।

মসজিদের ঐতিহাসিকতা ও এর আশ্চর্য স্থাপত্য শৈলীর কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক মসজিদটি দেখতে আসেন। আমিও মন ভরে দেখলাম এই মসজিদটি। এর সামানে পবিত্র কোরআন, অনেক দামি পুস্তক, তসবিহ, সুগন্ধি আতর, সুরমা, বাঁধাই করা আরবী ক্যালিওগ্রাফি বিক্রির জন্য শত শত মুসলিম হকার।

কুতুব মিনারের সামনে লেখক।

দিল্লিতে বহু ঐতিহাসিক ইসলামী স্থাপনা রয়েছে। ৩২২ বছরে মুসলিম শাসকরা এইগুলি নির্মাণ করেছেন। মাজার আর মুসলিম শাসকদের সমাধিগুলি এখনো অক্ষত রয়েছে। আমি অবাক হয়েছি কুতুব মিনার দেখে, এই কুতুব মিনার দিল্লি শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত একটি বিজয়স্তম্ভ। এটি মুসলমানদের ভারত বিজয়ের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৭০০ বছর ধরে।

সুলতান মুহাম্মদ ঘুরির সেনাপতি ও প্রতিনিধি কুতুব-উদ-দিন আইবেক ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে চৌহান রাজা পৃথ্বিরাজকে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত করেন। এ বিজয়ের অব্যাবহিত পরে তিনি দিল্লি অধিকার করে কুওয়াতুল ইসলাম নামে একটি মসজিদ এবং এর সংলগ্ন একটি মিনার নির্মাণ করেন। এ মিনারটি ভারতবর্ষের মুসলিম ঐতিহ্যের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত কুতুব মিনার ভারত বর্ষের সর্বোচ্চ টাওয়ার। এর উচ্চতা ৭২.৫ মিটার। মিনারের অভ্যন্তরে উপরে উঠার সিঁড়ি রয়েছে ৩৭৯টি। নিচের দিকে মিনারের আয়তন ১৪.৩ মিটার এবং উপর দিকে ব্যাস ২.৭৫ মিটার। কুতুব মিনারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মনোরম একটি কমপ্লেক্স। ১০০ একর জমির উপর স্থাপিত এ কমপ্লেক্সে রয়েছে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, আলাই মিনার, আলাই গেট, সুলতান ইলতুৎমিশ, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন, সুলতান আলাউদ্দিন খলজী ও ইমাম জামিনের সমাধি। সব দেখে আবারো মনে হলো দিল্লি মুসলিমদের ছিলো এখনো আছে।

পথ চলতে অনেকের সাথে কথা হলো রাস্তার ধারের ফল বিক্রেতা কিংবা সুপারশপের ব্যবস্থাপক। সবাই মুসলিম। সবাই জানালো ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ভালো আছি। এই ভালো থাকা ছিলো আমার চাওয়া।

সেই গুজরাটের কাহিনী শুনলাম। মাঝে মাঝে দাঙ্গা হয়। কাশ্মীরের ঘটনা শুনলাম। পাহাড়গঞ্জে আসামীয় মুসলিম মালিকাধীন একটি ট্রাভেল কার্যালয়ে বসে। কিন্তু দিল্লি সব সময় শান্ত। একটি শান্তির রাজ্য।

আম আদমি পার্টির (এএপি) আহ্বায়ক অরবিন্দ কেজরিওয়াল টানা তৃতীয় মেয়াদের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন সম্প্রতি। আমি যখন দিল্লিতে তখন তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায়। অসম্ভব জনপ্রিয়তা তাঁর। নাগরিক সুবিধা দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয়জয় করে নিয়েছেন। বিদ্যুৎ বিল অর্ধেক, কর্মজীবী মহিলাদের ফ্রি বাস ভাড়া দুটি বিষয়সহ আন্যান্য নাগরিক সুবিধা তাঁকে ৩য় মেয়াদে ক্ষমতায় এনেছেন।

তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতিও খুব সজাগ ছিলেন। কিন্তু সামান্য নাগরিক আইনের প্রতিবাদ থেকে হিংসার আগুনে রূপ নিবে? কি দোষ ছিল, প্রতিবাদ যদি দাঙ্গায় রূপ নেয় তাহলে এতোদিনের শান্তির কি মূল্য আছে? দিল্লির প্রতি মুসলমানদের ভীত কি নড়েবড়ে হয়ে উঠলো। এসব শত প্রশ্নের উত্তর কি মিলবে? দিল্লির পাহাড়গঞ্জের দরিদ্র রিকশাচালক রমিজ উদ্দিনের মুসলিম অধ্যুসিত এলাকার ঝুপড়ি ঘরটি রক্ষা পেয়েছে নাকি হিংসার আগুনে পুড়ে গেছে ডাল ভাতের জন্য লড়াই করার সেই রিকশাটি। নাকি রেলস্টেশনে বোরকা পড়া বৃদ্ধ মহিলা যে কি না সূরা পড়তে পড়তে হাত পেতে ভিক্ষা করেছেন তার হাত পাতা বন্ধ রয়েছে।

দাঙ্গা কোন সমাধান নয়, শান্তিই সমাধানের পথ।

দাঙ্গার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথাযথই বলেছেন, ‘মানুষের চিন্তা-চেতনার সক্রিয় রুপ- নিত্য আচারণে সমন্বয় ভাবনার অভাব ঘটলেই ব্যক্তির সমষ্টি সমাজ-দেহেও তার প্রভাব পড়ে। অসহিষ্ণুতা, মনোমালিন্য থেকে ছোট-বড় সংঘর্ষ। আর এসবেরই আকস্মিক ও সংগঠিত বিস্ফোরণ হলো দাঙ্গা। …

সুতরাং সাধু সাবধান। সদা আত্মসমীক্ষা করে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করতে হবে। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ রচনা করে জাতিবৈর ও দাঙ্গা নিরসনের উদ্দেশ্য প্রতিটি নাগরিকের এই দায়িত্ব, সাধনা।

লেখক : সভাপতি, মাদারগঞ্জ প্রেসক্লাব
ও বাংলারচিঠিডটকম এর প্রতিনিধি

দিল্লির গল্প-২ : দিল্লিকা লাড্ডু জো খায়া ও পস্তায়ে, জো নেহি খায়া ও ভি পস্তায়ে পস্তায়া