তুহিন ও নাসরিনকে ফিরে পেতে স্বজনদের আকুতি

তুহিন সরকার ও তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার রুমি। ছবি : বাংলারচিঠি ডটকম

নিজস্ব প্রতিবেদক, জামালপুর
বাংলারচিঠি ডটকম

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়নের মধ্যেরচর গ্রামের বাড়িতে দিনেদুপুরে হানা দিয়ে তুহিন সরকার (২২) নামের এক যুবক ও তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী নাসরিন আক্তার রুমিকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে সাদাপোশাকের আইন-শৃংখলাবাহিনীর সদস্যরা। ৪ নভেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় এ ঘটনা ঘটে।

তুহিনের পরিবারের সদস্যদের দাবি পুলিশের উপস্থিতিতেই সাদাপোশাকপরা লোকজন বিনা কারণে তুহিন ও তার স্ত্রীকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গেছে। ৫ নভেম্বর রাত পর্যন্ত তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত হতে পারেনি পরিবারটি। এ নিয়ে ওই পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশীরা নানা শঙ্কায় সময় পার করছেন। তাদেরকে জীবিত ফিরে পেতে আকুতি জানিয়েছেন তারা। অপরদিকে ওইদিন ওই গ্রামে এ ধরনের কোনো অভিযানে থানার কোনো পুলিশ অংশ নেয়নি বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট মোলান্দহ থানার ওসি।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার মেলান্দহ উপজেলার চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়নের মধ্যেরচর গ্রামের বাসিন্দা বিএডিসির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী জসিম উদ্দিন সরকার ও সুলতানা ফেরদৌসীর চার সন্তানের মধ্যে তুহিন সরকার (২২) কণিষ্ঠ। তুহিনের এক ভাই ফেরদৌস হাসান সেনাসদস্য হিসেবে ঢাকায় কর্মরত। আরেক ভাই তারেক হাসান জামালপুর শহরের একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তুহিন এসএসসি পাস করার পর আর পড়ালেখা করেননি। বাড়িতেই সংসার দেখাশোনা করেন। বছরখানেক আগে তুহিন একই উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের নূর মোহাম্মদ মুসল্লির মেয়ে নাসরিন আক্তার রুমিকে বিয়ে করেন। রুমি একজন গৃহিনী। বর্তমানে তিনি অন্ত:সত্ত্বা।

ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান বাবা জসিম উদ্দিন সরকার ও মা সুলতানা ফেরদৌসী। ছবি : বাংলারচিঠি ডটকম

৪ নভেম্বর মসজিদ থেকে আছর নামাজ পড়ে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বাড়িতে যাচ্ছিল তুহিন। বাড়ির সামনেই স্থানীয় ছেলেদের সাথে তিন-চারজন অচেনা লোক সাদাপোশাকে ক্রিকেট খেলা বাদ দিয়ে তুহিনকে তার নাম জিজ্ঞেস করে। নাম বলার সাথে সাথেই তারা তুহিনকে আটক করে। সাদাপোশাকের ওই লোকজনের সাথে আরো কয়েকজন সাদাপোশাকধারী লোকজন মিলে তুহিনকে তার ঘরে নিয়ে ব্যাপক তল্লাশি চালায়। এ সময় বাড়ির সামনে জামালপুর-মাদারগঞ্জ পাকা রাস্তায় একটি মাইক্রোবাস, চারটি সিএনজি অটোরিকশা ও পুলিশের দুটি পিকআপভ্যান গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। পুলিশের পিকআপভ্যানে সাদাপোশাকে কয়েকজন নারী পুলিশ সদস্যসহ পুলিশের পোশাকপরা অস্ত্রধারী পুলিশ বসে থাকতে দেখা গেছে। সাদাপোশাকের নারী পুলিশ সদস্যরা তুহিনের বাড়িতে অভিযানে অংশ নিলেও অন্য পুলিশ সদস্যরা গাড়িতেই ছিল। তল্লাশি শেষে সাদাপোশাকধারী লোকজন তুহিন ও তার অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী নাসরিনকে তাদের দুটি মুঠোফোন সেটসহ মাইক্রোবাসে উঠিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এ সময় তুহিনের অসুস্থ বাবা-মা ছেলে আর ছেলের বউকে কেন উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে অভিযানকারী দলের কেউ তাদের কোনো কথার জবাব দেয়নি বলে তারা জানিয়েছেন।

এদিকে তুহিনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ওই বাড়িতে তার স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। দিনেদুপুরে আকস্মিক বাড়িতে হানা দিয়ে এক দম্পতিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখে অভিযানের পর প্রতিবেশীরা ওই বাড়িতে ভিড় করেন। ৫ নভেম্বর বেলা ১২টার দিকে বাংলারচিঠি ডটকমের এ প্রতিবেদক তুহিনদের বাড়িতে গেলে স্থানীয় লোকজন ও প্রতিবেশীরা তুহিন ও তার স্ত্রীকে পুলিশের লোকজনরাই উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে ঘটনার বর্ণনা দেন। কিন্তু তার স্বজনরা মেলান্দহ থানায় যোগাযোগ করলে থানা থেকে এ ধরনের কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি বলে জানিয়ে দিলে স্বজনদের মধ্যে শঙ্কা আরো বাড়তে থাকে। ৫ নভেম্বর রাত পর্যন্ত তারা তুহিন ও তার স্ত্রীর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি।

তুহিনের অসুস্থ বাবা মফিজ উদ্দিন সরকার (৭০) বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, তুহিন বাড়িতেই সংসার দেখাশোনা করে। কোথাও যায় না। বাড়ির কাছেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। বিকেলে বাড়ির সামনেই স্থানীয় ছেলেদের নিয়ে ক্রিকেট খেলে। ও আমার খুব আদরের ছেলে। ওর নামে থানায় কোনো মামলাও নেই। কেউ ওর কাছে কোনো টাকা পয়সাও পায় না। তুহিন ব্যবসা করবে বলে বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার পাশে বড় একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছি। সেখানেই তার ব্যবসা শুরু করার কথা ছিল। আমার ছেলে আর ছেলের বউকে কেন তারা ধরে নিয়ে গেলো বুঝতে পারছি না। সাদাপোশাকের লোকজনদের কাছে জানতে চাইলে তারা আমার কোনো কথাই শুনলো না। আমি আমার ছেলে আর ছেলের বউকে ফেরত চাই। দুটি গাড়িতে পুলিশের উপস্থিতিতেই সাদাপোশাকপরা লোকজনরা তার ছেলে আর ছেলের বউকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।

তুহিন সরকারের বাড়িতে প্রতিবেশীদের ভিড়। ছবি : বাংলারচিঠি ডটকম

তুহিনের সহোদর তারেক হাসান বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, ঘটনার পরপরই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আমি নিজে মেলান্দহ থানার ওসিকে বিষয়টি অবহিত করেছি। জিডি করতে চাই। ওসি মেলান্দহ থানার কোনো পুলিশ গাড়িসহ ওই অভিযানে যায়নি বলে স্বীকার করেন এবং জিডি করার পর বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। ঘটনাটি আমার ছোটভাই সেনাসদস্য ফেরদৌস হাসানকেও জানানো হয়েছে। আমরা মেলান্দহ থানায় জিডি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

মেলান্দহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী মো. সাখাওয়াত হোসেন এ প্রসঙ্গে বাংলারচিঠি ডটকমকে বলেন, তুহিন ও তার স্ত্রীকে কে বা কারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে সে সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। তবে স্থানীয় লোকজন ও তুহিনের স্বজনরা আমাকে ঘটনাটি জানিয়েছে। তার স্বজনরা জিডি করতে চেয়েছেন। তারা এলে জিডি গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, সারা দেশে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি আইনশৃংখলাবাহিনী অপরাধীদের ধরতে কাজ করছে। তুহিন সম্পর্কে তাদের কাছে হয়তো কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু মেলান্দহ থানা থেকে ৪ নভেম্বর সারাদিন কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। ওইদিন প্রতিমন্ত্রীর দুটি কর্মসূচিতে আমরা ব্যস্ত ছিলাম।