জামালপুরে শিল্প-প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি ও আমাদের করণীয়

মো. রেজাউল করিম রেজা, জামালপুর ॥
কেউ কি বলতে পারবেন জামালপুরের ভৌগোলিক অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সুবিধাজনক থাকার পরও এখানে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা গড়ে উঠেনি কেন? কেন আমরা শিল্পে পিছিয়ে? আচ্ছা চলুন জেনে নেই একটি শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কয়টি মূল উপাদানের প্রয়োজন হয়। ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন। এগুলোকে অর্থনীতিতে উৎপাদনের উপকরণও বলা হয়। এখন চিন্তা করে দেখুন তো জামালপুরে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কোন উপাদানটির অভাব সবচেয়ে বেশি। বেশির ভাগ মানুষ এটা স্বীকার করবেন যে আমাদের মূলধন বা টাকা নেই। কেন মূলধন বা টাকা নেই? মূলধন কিভাবে গঠন হয়? আপনার আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে যা থাকে তাকে আমরা বলি সঞ্চয় বা জামালপুরের ভাষায় ‘জোলা’। এ থেকেই কিন্তু মূলধন গঠন হয়।

বিশ্বের একসময়ের শীর্ষ এবং বর্তমানে তৃতীয় ধনী ব্যক্তিত্ব ওয়ারেন্ট বাফেটের একটা উক্তি আমার খুবই পছন্দের ‘খরচের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা থেকে সঞ্চয় না করে বরং সঞ্চয়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা খরচ করুন’। মানুষকে মূলত চারটি কারণে প্রতিনিয়ত সঞ্চয় করতে হয়। কোনো জরুরী প্রয়োজন বা অনাকাঙ্খিত ঘটনা সামাল দিতে, কোনো সম্পদ অর্জনে, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য এবং বিনিয়োগ করতে। আমরা জামালপুরবাসীরা সঞ্চয়ে খুব অভ্যস্থ নই। যা আয় করি তাই ব্যয় করি। পারলে ঋণ করে ব্যয় করি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালিত পরিবার ও আয়-ব্যয় জরিপ-২০১০ মতে জামালপুর জেলার মানুষের মাথাপিছু মাসিক ভোগ ব্যয় বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কমের দিক থেকে দ্বিতীয়, প্রথম কুড়িগ্রাম। এই যে আমাদের ভোগ ব্যয় কম এর প্রধান দুটি কারণ আমাদের আয় ও সঞ্চয় কম। একই প্রতিবেদন অনুসারে আমাদের মাথাপিছু মোট জেলাভিত্তিক উৎপাদন ৩২ হাজার ৯২২ টাকা হলেও সঞ্চয় হার খুবই কম, মাত্র শতকরা ১১.৭৫ ভাগ। যেখানে মেহেরপুরের মাথাপিছু মোট জেলাভিত্তিক উৎপাদন ৩৬ হাজার ৪১৪ টাকা এবং সঞ্চয় হার শতকরা ২৯.৬২ ভাগ, যা জেলাভিত্তিক ভাবে সর্বোচ্চ সঞ্চয় হার।

বর্তমান আর্থিক খাতে একটা বিষয় খুবই আলোচিত আর তা হচ্ছে ফিনান্সিয়াল ইনক্লোশন বা আর্থিক অন্তর্ভূক্তিকরণ। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বচ্ছ ও নিরাপদ উপায়ে মূলধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আর্থিক (মূলত ব্যাংকিং) সেবাবঞ্চিত সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে সঠিক আর্থিক সেবা পৌঁছানোর মাধ্যমে সঞ্চয় বৃদ্ধি করে জাতীয় মূলধন গঠন ও তার ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ব্যাংক-বীমার মত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো না থাকায় জনসংখ্যার বৃহৎ একটা অংশ একদিকে অর্থ সঞ্চয় করতে পারছে না অন্যদিকে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না। এই সমস্যা দূরীকরণের জন্য আর্থিক অন্তর্ভূক্তিকরণ কৌশলের আওতায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের কিছু সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। এ সকল সেবা এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ইত্যাদির মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে।

আমাদের জেলার একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে এগুলো ব্যবহার করে সঞ্চয় গঠন করতে পারে? গ্রামে স্বল্প আয়ের একজন মানুষ ইচ্ছে করলে ১০ টাকা দিয়ে যেকোনো ব্যাংকের শাখায় কিংবা এদের এজেন্টের কাছে সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে পারে। স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সহজে স্টুডেন্ট একাউন্ট খুলতে পারে। যেখানে তার সাধ্যমত টাকা সঞ্চয় রাখতে পারে। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন ছাত্র-ছাত্রীদের এই স্কুল ব্যাংকিং-এই অল্প অল্প সঞ্চয়ে গত ডিসেম্বর, ২০১৭ পর্যন্ত জমা হয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও সাধারণ মানুষ স্বল্প টাকার কিছু স্কিম (ডিপিএস) চালু করতে পারে। সম্পদ বিক্রয় বা অন্য কোনো উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ মেয়াদী আমানতে (এফডিআর) রাখতে পারে। ইচ্ছে করলে তাদের মোবাইল ব্যাংকিং এ শুধু টাকা স্থানান্তর না করে কিছু অর্থ সঞ্চয় করে রাখতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং কিছু কিছু এনজিও আছে যারা সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক সঞ্চয় গ্রহণ করে এককালীন লাভসহ মূলধন ফেরত দেয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, জামালপুর জেলায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৮টি ব্যাংকের ৫০-৬০টি শাখা আছে। এসব শাখায় একটা হিসাব খুলে শাখায় না গিয়েও মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে টাকা জমা ও স্থানান্তর করা যায়।

তাছাড়া কিছু কিছু ব্যাংক বিভিন্ন এলাকায় তাদের এজেন্ট নিয়োগ করেছে। এই সকল এজেন্টের কাছেও নিশ্চিন্তে টাকা জমা দেওয়া যাবে যার নিরাপত্তা স্বরূপ ব্যাংক আপনার মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে আপনার হিসাবে টাকা জমা হওয়া নিশ্চিত করবে। এক ব্যাংকের ডেবিট কার্ড নিজে ব্যাংক ছাড়াও অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথে ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। এজন্য অনেকগুলো বুথও স্থাপন করা হয়েছে। সামনে আসছে ক্যাশ রিসাইকেলার মেশিন বা সিআরএম, যেখানে টাকা উত্তোলনের পাশাপাশি জমাও দেওয়া যাবে।

আমাদের এলাকার অনেক মানুষ আছেন যারা অর্থ নিজ ঘরে সিন্দুকে, আলমারিতে কিংবা মাটির ব্যাংকে জমা রাখেন। এটা খারাপ না। তবে টাকাটা যদি দীর্ঘ মেয়াদে সেখানেই থাকে তবে অর্থনীতিতে টাকার হাতবদল কমে যায় এবং এতে টাকার উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত হয়। তাই আপনার স্বল্প জমাকৃত অর্থও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা হওয়া উচিৎ। এতে একদিকে আপনার অর্থের বৃদ্ধি ঘটবে অন্যদিকে জাতীয় সঞ্চয় বেড়ে যাবে। আর নগদ টাকা নিজের কাছে রাখলে তা খরচ হয়েই যাবে তা সে যেভাবেই হোক।

প্রশ্ন আসতে পারে স্বল্প আয়ের মানুষ কিভাবে সঞ্চয় করবেন। দেখেন সঞ্চয় বিষয়টা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ইচ্ছেশক্তির উপর। কেউ এক লক্ষ টাকা আয় করেও সঞ্চয় করতে পারে না আবার কেউ দশ হাজার টাকা আয় করেও সঞ্চয় করে। সঞ্চয় একশত টাকাও করা যায় আবার হাজার টাকাও করা যায়। পরিমাণ যায় হোক না কেন সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলায় হল মূখ্য। আমাদের ব্যাংকে এমন অনেক গ্রাহক আসেন যারা বলেন এই ডিপিএসটি অমুক লোক জোর করে করিয়েছিল, আমি করতে চাইনি। অথচ আজ কতগুলো টাকা পেলাম। আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় আপনাকে একসময় অনেক বড় একটা অর্থের স্বাদ দিবে। সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কিছু উপায় অবলম্বন করতে পারেন। প্রথমত আপনার আয়ের কত ভাগ সঞ্চয় করতে চাচ্ছেন তা ঠিক করুন। আয় যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ নাও হয় তবুও আনুমানিক একটা আয় ধরে তার সঞ্চয় হার নির্ধারণ করুন। আপনার ব্যয়ের সঠিক হিসাব রাখুন, একটা বাজেট তৈরি করুন, কিসের জন্য সঞ্চয় করবেন তা নির্ধারণ করুন, ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন, কোথায় সঞ্চয় করবেন তা ঠিক করুন। কিছু কিছু সঞ্চয়ী হিসাব আছে যা আপনার মূল ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেয়, এগুলো বেছে নেন। এতে আপনার সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে।

এখন দেখা যাক এত কিছু করে মূলধন কিভাবে গঠন হবে এবং এলাকায় শিল্প-কারখানা কিভাবে গড়ে উঠবে। জামালপুর জেলা তথ্যবাতায়ন অনুসারে আমাদের জেলায় মোট জনসংখ্যা ২৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮১০ জন। এদের যদি ন্যূনতম শতকরা ২৫ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৬ লাখ লোক যদি মাসে গড়ে ৫০০ টাকা করে সঞ্চয় করে তবে একমাসে টাকা সঞ্চয় হবে ৩০ কোটি টাকা বছরে ৩৬০ কোটি টাকা। দুই-একটা মাঝারি মানের শিল্প-কারখানা করার জন্য এই অর্থ যথেষ্ট। এই সঞ্চিত অর্থগুলো একত্রিত করে বিনিয়োগের জন্য ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যাংকগুলো। আর ব্যাংকগুলো সাধারণত যে এলাকা থেকে ডিপোজিট সংগ্রহ করে সেই এলাকায় ঋণদানে বেশি আগ্রাধিকার দেয়।

তাই আমরা জামালপুরের মানুষ যদি প্রত্যেকে কিছু কিছু সঞ্চয় করি এবং তা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জমা করি তবে জামালপুরে শিল্প-কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের জন্য যে মূলধন দরকার তা সহজেই পূরণ হবে। প্রশ্ন করতে পারেন এইসব শিল্প-কারখানা গড়ে তুলবে কে। এ চিন্তা আপাতত ব্যাংকওয়ালা ও শিল্প উদ্যোক্তাদের উপর ছেড়ে দেন। ব্যাংকে ডিপোজিট বেশি হলে তারাই খুঁজে বের করবে কাকে দিয়ে কোথায় বিনিয়োগ করালে লাভসহ মূলধন ফেরত আসবে।

অতএব আমাদের স্বল্প সঞ্চয় আমাদের জেলার আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে অন্তর্ভূক্ত করতে পারলে জেলার সার্বিক মূলধন গঠন হবে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে আর বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে এলাকায় নতুন নতুন ছোট-মাঝারি থেকে বড় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। জেগে উঠো জামালপুরবাসী।

মো. রেজাউল করিম রেজা : একজন ব্যাংকার