বাতিল হচ্ছে বাহাদুরাবাদ-বালাসী ঘাট ফেরি সার্ভিস প্রকল্প?

বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট টার্মিনাল। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

বিল্লাল হোসেন মন্ডল, দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি
বাংলারচিঠিডটকম

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বাহাদুরাবাদ ঘাটে ১৪৫ কোটি টাকা খরচ করে স্থাপনা নির্মাণের পর বাহাদুরাবাদঘাট ও বালাসী ঘাট নৌপথে ফেরি সার্ভিস বাতিলের সুপারিশ করেছে বিআইডব্লিউটিএ-এর কারিগরি কমিটি। একই কমিটি স্থাপনাগুলো অন্য কাজে ব্যবহারের সুপারিশ করেছেন।

জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৯ মার্চ বিআইডব্লিউটিএ প্রশাসন সংক্রান্ত এক সভায় বাহাদুরাবাদ-বালাসী ঘাট নৌপথটি আবারও চালু করে ফেরিঘাট ও নৌ-টারমিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।

২০১৪ সালের ১২ মার্চ নৌমন্ত্রী, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে ফেরি চালুর বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে একনেক সভায় এই প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছেছিল ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প দুই বার সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি দুই লাখ টাকা করা হয়।

২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়। এর মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৩৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে এসে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কারিগরি টিম গঠন করে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।

এপ্রিল-মে মাসে কমিটি সরেজমিনে এই নৌপথের সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনে নৌপথের নাব্যতা সংকট, ২৬ কিলোমিটারের দূরত্বের নৌপথ, একবার পার হতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগা এবং স্টেকহোল্ডার অ্যানালাইসিস ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না প্রকল্পের স্থান নিরুপণ করাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে এই পথে ফেরি চলাচলের উপযোগী নয় বলে মতামত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবেদনে দুই প্রান্তের ফেরিঘাট অন্যত্র স্থানান্তরসহ নির্মিত স্থাপনা অন্য কাজে লাগানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট টার্মিনাল। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

বিআইডব্লিউটিএ কারিগরি কমিটির সিদ্ধান্ত উত্তরবঙ্গের ১৩টি জেলার যাত্রীদের মাঝে হতাশা নেমেছে। প্রকল্পের ১৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আনসার ব্যারাকসহ অনেক স্থাপনা নির্মাণ করার পর কারিগরি কমিটি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত প্রদান করায় বিআইডব্লিউটিএ এর কাজের ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট চালু করে। এক সময় এই ঘাটের নাম-ডাক ছিল দেশজুড়ে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শেষ বিদ্রোহী নেতা সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নাম অনুসারে বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়। শুরুতে ঘাট বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল আর সেই নাম অনুসারেই পরবর্তীকালে বাহাদুরাবাদ ঘাটের নামকরণ করা হয়।

এরপর থেকে উত্তরবঙ্গের ১৩টি জেলার হাজার হাজার লোক এই ঘাট দিয়ে পার হয়ে ট্রেনে ঢাকাসহ দেশের উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ময়মনসিংহ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষা করে চলে আসা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর ২০০৫ সালের ১৫ জুন এই ফেরি ঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নদীপথে চলাচল করছে। প্রতিকূল পরিবেশে ও আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় বহু লোক নৌকা ডুবে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। ছোট ছোট নৌকায় শত শত যাত্রী যমুনা নদী দিয়ে পার হচ্ছে।

দুই পাড়েই বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ আছে। এভাবেই চলছে যমুনার দুই পারের লোকজনের যাতায়াত।

এব্যাপারে দেওয়ানগঞ্জের সচেতন মহল জানান, বর্তমান প্রকল্পটি বাতিল হলে ১৩ জেলার মানুষের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাবে। ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প তদন্ত কমিটির কলমের খোচায় বিলুপ্ত হযে যাবে তা মেনে নেওয়া যায় না। যাত্রী সাধারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।

ফুলছড়ি উপজেলার খাটিয়ামারী এলাকার শাহজাহান জানান, বাহাদুরাবাদ ঘাট জামালপুর জেলাসহ ১৩ জেলার মানুষের প্রাণের সাথে মিশে আছে। এই ঘাটের ঐতিহ্য বিলীন হলে অনেক ইতিহাস মুছে যাবে। দুই পাড়ের মানুষের উন্নয়নে বাহাদুরাবাদ ঘাট চালু করা জরুরী।

বাহাদুরাবাদ ঘাট এরিয়ার চুকাইবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রাসেদুজ্জামান সেলিম খান বলেন, ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে তিন ঘণ্টায় নৌকায় পারাপার হচ্ছে মানুষ। তারা নিরুপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছে। ফেরিঘাট চালুর খবরে দুপাড়ের মানুষের মাঝে আনন্দ দেখা দিলেও সে আশায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিলো তদন্ত কমিটি। হাজার হাজার যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে ফেরি চালু করার দাবি জানান তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ কে এম আব্দুল্লাহ বিন রশিদ জানান, ফেরিঘাট চালু হলে মানুষের যাতায়াতের অনেক সুবিধা হবে এবং এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে। আশা করি কারিগরি কমিটি আবার সমীক্ষা চালিয়ে কিভাবে নৌ-পথটি চালু করা যায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোলায়মান হোসেন বলেন, এ ফেরিঘাট চালু হবে, এটি এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি ছিল। ফেরিঘাট চালুর স্বপ্নে আশায় বুক বেঁধে ছিল সবাই- এ ঘটনায় আশাহত হয়েছে। নৌ-পথ পুনরায় চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি করছি।

জামালপুর-১ আসনের এমপি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, বাহাদুরাবাদ-বালাসী ফেরিঘাটটি চালু করার জন্য যা কিছু করা দরকার তা-ই করব। ডেপুটি স্পিকার আইনজীবী ফজলে রাব্বি মিয়া চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন, তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি সুস্থ হয়ে দেশে এলে দুইজন মিলে উদ্যোগ নেয়া হবে।