হাতি আর করোনার ভয়ে দিশাহারা শেরপুর সীমান্তের ১২ হাজার মানুষ

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর
বাংলারচিঠিডটকম

মেলা দিন অইলো, এক বেলাও ঠিক মতো খাইতে পাইনা। সরহারের (সরকার) লোক আহে, মেম্বাররা আহে, খালি হাত ধোবার কয়, খাবার দেয় না। কেমনে বাঁচুম? পোলাপানগরেই ক্যামনে বাঁচামু? মানুষের কাছ থেইক্কা ধার লইয়া বোরো ধান লাগাইছি। এডাও হাত্তি (হাতি) আইয়া খাইয়া ফাইলাইতাছে। এহন করোনা রোগের কারণে মাইনসের (মানুষ) বাড়িত কামেও নেয়না। কেউ আমগোরে খবর নেয় না। অহন আমগোরে মরার ওপর খড়ার ঘা হইয়া দাঁড়াইছে হাত্তির (হাতি) হামলা। কথাগুলো বলছিলেন, শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সিংগাবরুনা ইউনিয়নের ভারত সীমানা ঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চল বাবেলাকোনা গ্রামের লেটারসন মারাকের স্ত্রী পিরলা সাংমা (৪৫)। তিনি জানান, এক দিকে বুনোহাতি অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের ভয়। এ কারণে উভয় সংকটে পড়ে টিকে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

একই গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মিয়া, নুরতাজুল হক, দুলাল মিয়া ও পার্শ্ববর্তী চান্দাপাড়া গ্রামের আমজাদ হোসেন, ফুলু মিয়া, গোলাপ মিয়াসহ আরো অনেকে জানান, দিনে করোনাভাইরাসের ভয়ে তারা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। অন্যদিকে রাতে চলে বুনোহাতির আক্রমণ। হাতির দল বোরো ক্ষেতের আধাপাকা ধান খেয়ে ফেলছে। এছাড়া পা দিয়ে মাড়িয়ে ক্ষতি করছে বিস্তীর্ণ জমির ধান ক্ষেত। বাদ যাচ্ছে না শাকসবজির ক্ষেতও। গত তিনদিনে ৭০ বিঘা জমির বোরো ধানের থোর খেয়ে সাবার করেছে হাতি। ফলে চরম সংকটে পড়েছেন সীমান্ত এলাকার বাবেলাকোনা, হারিয়াকোনা, চান্দাপাড়া, মেঘাদল, বকুলতলা, মালাকোচা, খ্রিষ্টানপাড়া, খারামোরা ও বালিজুরিসহ ২০টি গ্রামের প্রায় ১২ হাজার মানুষ।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকা কর্মহীন ও অসহায় লোকদের জন্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও চলছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ নানা প্রচার কার্যক্রম। চলছে বাজার মনিটরিং। এমনকি অভুক্তদের খাদ্য সহায়তার জন্য ২৪ ঘন্টা যোগাযোগে খোলা রাখা হয়েছে একটি মোবাইল নাম্বার।

স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হারুন আর রশীদ বলেন, গ্রামাঞ্চলের অনেক অভুক্ত লোক জানেনা প্রশাসনের দেওয়া মোবাইল নাম্বার। দু’একজন যদিও নাম্বার পেয়েছেন। তারা ফোন দিয়েও কোনা সাড়া পাচ্ছেন না।

সাবেক ইউপি সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা ভূপেন্দ্র মান্দা বলেন, এখানকার বেশিরভাগ লোকজন খেটে খাওয়া। দিন আনে দিন খায়। এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মানুষজন করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে। মেম্বার চেয়ারম্যানরা ঠিকমতো ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছেন না। ফলে অনেক মানুষ এখন খাবারের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আর অন্যদিকে সীমান্ত এলাকায় শুরু হয়েছে বুনোহাতির আক্রমণ। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের লোকজন চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

 

সিংগাবরুনা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রেজ্জাক মজনু মিয়া বলেন, অভাবি মানুষ বেশি। ত্রাণের পরিমাণ একেবারেই কম। এ জন্য অনেকেই বাদ পড়ছেন। তিনি জানান, কয়েকদিন থেকে প্রতিরাতে বুনোহাতির উপদ্রবে বোরো ধান ক্ষেত নষ্ট হচ্ছে। হাতির অত্যাচারে রাতে কেউ ঘুমাতে পারে না। রাত জেগে স্থানীয়রা ধান ক্ষেত পাহারা দিচ্ছেন। এ বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক আনোয়ার হোসেন বলেন, এ উপজেলায় দুইজন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। তাদেরকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন জনের নমুনা সংগ্রহ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হচ্ছে।

বুনোহাতি কয়েকজনের ক্ষেত নষ্ট করেছে। তাদের তালিকা করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা আক্তার বলেন, প্রত্যেক দিন ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া করোনা সংক্রমণ বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করতে পৌর শহরসহ প্রত্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান আছে।

শেরপুরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৯৫ সাল থেকে বুনোহাতির আক্রমণে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ জন মানুষ মারা গেছে। অন্যদিকে আহত হয়েছেন শতশত মানুষ। আর বিস্তীর্ণ আবাদি জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। জেলার সীমান্তবর্তী শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে এসব ক্ষয়ক্ষতি ও নিহত আর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।