প্রতি বছর জামালপুরে সাঁতারনা জানার কারণে অসংখ্য শিশু অকালে প্রাণ হারায়। এ অস্বাভাবিক মৃত্যুস্রোত রোধ করতে উন্নয়ন সংঘ ও ওয়ার্ল্ড ভিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রাম (এপি) এর শিশু ও যুব ফোরামের উদ্যোগে অভিনব কায়দায় সাঁতার শিখা কার্যক্রম শুরু হয়েছে ।
জামালপুর পৌরসভার ১২ নং ওয়ার্ডের রামনগর গ্রামে রফিক মিয়ার পুকুরে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ৭০ জন শিশুকে সাঁতার শিখা প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১০ জনের দল করে ঘন্টাব্যপী সাতার শিখানো হয়। প্রতিদিন এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
রামনগর শিশু ও যুব ফোরামের প্রশিক্ষিত কিশোরী ও যুবরা টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে সাঁতার শিখা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় উন্নয়ন সংঘের কমিউনিটি ফ্যাসিলিটেটর শ্যামল দক্ষতার সাথে এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এ ব্যপারে একাধীক অভিভাবক জামালপুর শিশু ও যুব ফোরামের এ ধরনের একটি মহতি কাজের প্রশংসা করে বলেন সাঁতার শিখতে পারলে সন্তানদের নিয়ে তারা আশংকামুক্ত থাকতে পারবেন। বর্ষার সময় এলাকায় ডোবা, নালা ভরে পানিতে টইটুম্বুর থাকে। এর আগে এ এলাকায় পানিতে ডুবে একাধি শিশু মারা গেছে। অনেকেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিনাই নদে গোছল করতে যায়। সাঁতার না জানা শিশুরা এ ক্ষেত্রে ব্যাপক ঝুঁকিতে থাকে।
এলাকার মুরব্বি রফিক মিয়া বলেন, এ ধরনের উদ্যোগের কথা শুনে বিনামূল্যে শিশুদের সাঁতার শিখার জন্য পুকুরের একটা অংশ ছেড়ে দিয়েছি।
এলাকার যুব ফোরামের সদস্য সৌরভ গর্বের সাথে বলেন, শিশুদের সাঁতার শিখার কার্যক্রমে আমরা এলাকাবাসী ভীষণভাবে খুশি হয়েছি। সবসময় পাশে থাকি। তিনি বলেন, প্রত্যেক এলাকায় যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে একটা শিশুও পানিতে ডুবে মারা যাবে না।
জামালপুর জেলা শিশু ফোরামের সভাপতি অর্পা বলেন, শিশুরাও পারে শিশুদের সুরক্ষা দিতে। সাঁতার শিখা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রাম এবং স্থানীয় প্রশাসন সহায়তা করলে আমরা আরও বেশি এলাকায় এ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারব।
এ কার্যক্রমে যিনি সবসময় তত্ত্বাবধান করে থাকেন উন্নয়ন সংঘের জামালপুর এপির সিডিও সাব্বির হোসেন রিয়াদ বলেন, শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করে রামনগর গ্রামটি বেছে নেই। জরিপের মাধ্যমে এ এলাকার ৭০ জন শিশুকে আমরা সাঁতার শিখার আওতায় নিয়ে এসেছি। সফলভাবে আমাদের কার্যক্রম চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন জামালপুর এপির আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য এবং এলাকার সুধীজনদের উপকরণ, আর্থিক ও কায়িক শ্রমের মাধ্যমে শিশু ফোরাম সাঁতার শিখার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

জামালপুর : সাঁতার প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় শিশুরা। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম
জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক মিনারা পারভীন বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসাবে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে বন্যার সময় পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাসকরণের লক্ষ্যে এ চিন্তার বিষয়টি নিয়ে শিশু ফোরামের সাথে শেয়ার করি। এ প্রেক্ষিতে পাইলটিং হিসেবে কর্মএলাকার মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ঝিনাই নদ সংলগ্ন রামনগর গ্রামে সাঁতার শিখা কার্যক্রম শুরু করা হয়। এই কার্যক্রমের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আমাদের সবগুলো কর্মএলাকায় সাঁতার শিখা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করব।
ওয়ার্ল্ড ভিশন জামালপুর এপির এরিয়া ম্যানেজার বিমল ডি কস্তা বলেন, সাঁতার শিখা কার্যক্রম সার্ভিস লার্নিং প্রজেক্টের আওতায় নেয়া হয়েছে। শিশু ফোরামের সভায় শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা ও ঝুঁকি বিষয়ে আলোচনা করা হয়। রামনগর শিশু ফোরাম অগ্রাধিকার দেয় সাঁতার শিখা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। সেই প্রেক্ষিতে সম্ভাব্যতা যাছাই করে এপির কন্ট্রিবিউশনের পাশাপাশি কমিউনিটির আগ্রহ, সহায়তা নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে সাঁতার শিখা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। আমাদের মডেল দেখে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে আসলে এ কার্যক্রমটা স্থায়ীত্বশীলতা পাবে। এনজিওরা মেয়াদভিত্তিক কাজ করে আর সরকার স্থায়ীভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
উন্নয়ন সংঘের পরিচালক কর্মসূচি মুর্শেদ ইকবাল বলেন, পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যুর স্রোত ঠেকাতে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে শিশু ফোরামের সাঁতার শিখা কার্যক্রম একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। উন্নয়ন সংঘের অন্যান্য কর্মএলাকায় কমিউনিটির মাধ্যমে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করব। জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রাম কারিগরি সহায়তাও দিবে।
জামালপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিন্নাত শহীদ পিংকী সাঁতার শিখা কাযক্রম পরিচালনার কথা শুনে অভীভূত হয়ে বলেন, উন্নয়ন সংঘ এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন সব সময় ইতিবাচক কাজ করে থাকে। তাদের প্রতিটি কাজই উদাহরণ হওয়ার মত। তিনি জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রামের শিশু ফোরামের উদ্যোগে সদর উপজেলার অন্যান্য এলাকায় সাঁতার শিখা কার্যক্রম হাতে নিলে উপজেলা প্রশাসন সবধরনের সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দেন।
জামালপুর পৌরসভার প্রশাসক এ কে এম আব্দুল্লাহ বিন রশিদ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, প্রতিটি এলাকায় স্থানীয়ভাবে এ ধরনের কার্যক্রম হাতে নিলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু হ্রাস পাবে। এত অল্প খরচে এমন মহৎ ও বড় কাজ পরিচালনা করা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। তিনি জামালপুর পৌর এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে সাঁতার শিখা কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য জামালপুর এরিয়ার প্রোগ্রামের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। পৌর প্রশাসক সাঁতার শিখা কার্যক্রম পরিচালনায় সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দেন।
সাঁতার শিখা কার্যক্রম হাতে নেয়ার আগে বেশকিছু প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হয়। যেমন- চাইর্ল্ড ফোরামের মিটিং, নগর উন্নয়ন কমিটির সভায় আলোচনা, পুকুর চূড়ান্ত করা, এলাকায় জরিপ করা, অভিবাকদের সাথে আলোচনা, কমিউনিটি সার্পোট সংগ্রহ, চাইর্ল্ড ফোরাম এপিতে আর্থিক সহায়তা জন্য আবেদন, সম্ভাব্য বাজেট তৈরি এবং সাঁতার শেখানোর মাচা, সিঁড়ি ও সুরক্ষা বেড়া তৈরি করা হয় । এরপর যুব ফোরাম ও শিশু ফোরামের মাধ্যমে সাঁতার শেখানো কার্যক্রম শুরু করা হয়।
স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে অভিনব কায়দায় সাঁতার শেখার ব্যবস্থা দেখতে এসে অনেকেই মন্তব্য করেছেন গরিবের সুইমিং পুল হিসাবে।
এ সুইমিং পুলে বাঁশ, কাঠ, তারকাটা, জিআই তার, নেট, কাপড়, টিউব ব্যবহার করা হয়েছে। এ কার্যক্রমে মোট ব্যয় হয়েছে ৫৭ হাজার ২০০ টাকা। এরমধ্যে এলাকার লোকজনে দান করেছেন ১৭ হাজার টাকা। বাকি টাকা অনুদান দিয়েছে জামালপুর এরিয়া প্রোগ্রাম।
জামালপুর জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে প্রতিটি এলাকায় সাঁতার শিখা কার্যক্রম গ্রেহণের জন্য শিশু সুরক্ষাকর্মীরা আহ্বান জানিয়েছে।