ডলার সংকট ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধি মোকাবিলায় খাদ্যশস্যের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ জোরদার

মিজান চৌধুরী :

ডলার সংকট মোকাবিলায় চাল আমদানির বিপরীতে জোর দেওয়া হচ্ছে কৃষকের কাছ থেকে বেশি হারে ধান সংগ্রহকে। এরই মধ্যে চাল আমদানি খাত থেকে ১৬শ কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এতে সাশ্রয় হবে কমপক্ষে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খোলাবাজারে স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। সেটি পূরণে অতিরিক্ত ৪৪৬ কোটি টাকা বেশি ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। ফলে মোট ভর্তুকি বেড়ে ৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। তবে অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্য সংগ্রহ খাতে ধান-চাল সংগ্রহ খাতে অতিরিক্ত ১২৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খাদ্যে ভর্তুকি ব্যয় বৃদ্ধি এবং আমদানি কমার কারণ জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন জানান, ওএমএস কর্মসূচি বিশেষ করে টিসিবি খাতে পণ্য বিক্রি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেড়েছে। এছাড়া আগে সাত মাস ওএমএস কর্মসূচি পরিচালনা হতো। এখন বছরজুড়েই চলছে। এ কারণে ভর্তুকি ব্যয় বাড়ছে। আর স্থানীয়ভাবে খাদ্য সংগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে আমদানি ব্যয় হ্রাস করা হয়েছে।

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখীর কারণে দেশের অর্থনীতিবিদরা এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে গরিব মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানোর জোরালো সুপারিশ আসে। বিশেষ করে খোলাবাজারে স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি আরও সম্প্রসারণ করতে বলা হয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টিসিবির পণ্য এক কোটি পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে ভর্তুকির অঙ্কও বৃদ্ধি পায়। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) শুরুতে ওএমএস কর্মসূচি বিতরণে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৫ হাজার ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এটি বেড়ে ৫ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সর্বশেষ তথ্যমতে, ভর্তুকির টাকা গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

এ মহূর্তে টিসিবি এক কেজি মসুর ডালে ৭৫, ছোলায় ৫৫, এক লিটার সয়াবিনে ৬০ এবং প্রতি কেজি চালে প্রায় ২০ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এ কারণে মানুষের কাছে টিসিবি পণ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশ থেকে চাল আমদানিতে ১৭৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ কমানো হয়। এটি মূলত অভ্যন্তরীণ খাতে চাল উৎপাদন এবং সংগ্রহ বেশি হবে-এমন টার্গেট নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থবছরের শুরুতে চাল আমদানিতে ২ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত বাজেটে ৮৪২ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ডলার সংকট এখনো কাটেনি। আমদানি ব্যয় কাটছাঁট হওয়ায় কমপক্ষে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে। এটি অনেক বড় সাশ্রয়। এজন্য কৃষকের কাছ থেকে বেশি পরিমাণ ধান ও চাল সংগ্রহের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বেশি সংগ্রহ করতে পারলে রিজার্ভের ওপর ডলারের চাপ কিছুটা হলেও কমবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর দেশের ভেতর থেকে খাদ্য সংগ্রহ বেশি হারে করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার এগোচ্ছে। এজন্য অর্থবছরের শুরুতে চাল সংগ্রহ বাবদ ৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা থাকলেও সেটি বাড়িয়ে ৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এতে ১২৪৯ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সর্বশেষ তথ্যমতে, ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধান ও চাল সংগ্রহ হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার ২২৩ মেট্রিক টন।

সরকারের হিসাবে, দেশের মানুষকে খাওয়াতে বছরে মোটামুটি ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চাল এবং ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন আটা লাগে। চালের প্রায় শতভাগ এবং গমের ১০ শতাংশের মতো দেশীয় জোগান থেকে আসে।

কৃষি মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) চাল, গম ও ভুট্টা মিলে ৫ কোটি ৪ লাখ ১৭ হাজার টন পাওয়ার প্রত্যাশা করছে, যা বিগত অর্থবছরের (২০২২-২৩) তুলনায় এই অর্থবছরে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৩ লাখ ১৯ হাজার টন বেশি। এর মধ্যে আউশ ৩৯ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন, আমন ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৯ হাজার টন, বোরো ২ কোটি ২১ লাখ ৫৮ হাজার টন, গম ১২ লাখ ১৪ হাজার টন এবং ভুট্টা ৫৮ লাখ ৮৯ হাজার টন। এর মধ্যে কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুটা ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। যদিও সেই ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ হয়নি।

জানা যায়, খাদ্য ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে চার লাখ মেট্রিক টন আমদানির চুক্তি কয়েকটি দেশের সঙ্গে হয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বুলগেরিয়ার সঙ্গে ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানির চুক্তি হয়েছে। রোমানিয়া (উৎস দেশ ইউক্রেন) থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন এবং জি টু জি ভিত্তিতে রাশিয়া থেকে ৩ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করা হবে। এজন্য সংশোধিত বাজেটে আমদানি ব্যয় বাড়ানো হয়। অর্থবছরের শুরুতে গম আমদানিতে বরাদ্দ রাখা হয় ২ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে বাড়িয়ে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা করা হয়।