বই আলোচনা : ‘জীবন-কথা মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার’

শারমিন মাশা :
জামালপুর-শেরপুর অঞ্চলের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার (১৯০৫-১৯৮৫)। জামালপুর জেলার উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে তাঁর নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি জামালপুর-শেরপুরবাসীর নিকট মির্জা সাহেব নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ আমলের বিশ শতকের চল্লিশের দশকে তদানীন্তন শেরপুর থানার ও বাংলাদেশ আমলের সত্তরের দশকে জামালপুরের দীর্ঘদিন প্রথম শ্রেণির ক্ষমতাপ্রাপ্ত অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। বিশ শতকের অবিভক্ত ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। জামালপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘তওফিক’ পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রক ছিলেন তিনিই। একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট প্রতিভা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘আসামের জঙ্গলে’ একটি ক্ল্যাসিকতুল্য ভ্রমণকাহিনি। এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাসহ অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন তিনি। জামালপুর শহরে তিনি ১৯৫৯ সালে প্রথম বিদ্যুতায়নে পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করেন। তদানীন্তন জামালপুর মহকুমার ঐতিহ্যবাহী জামালপুর পৌরসভার ১৯৬০-১৯৬৫ মেয়াদে ভাইস-চেয়ারম্যান (বর্তমানে মেয়র) ছিলেন তিনি। এ অঞ্চলে সমবায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অগ্রণী। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের জীবন-কথা নিয়ে গবেষক, প্রাবন্ধিক শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান একটি তথ্যবহুল ও প্রামাণিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।

‘জীবন-কথা মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার’ গ্রন্থখানা বিজয় প্রকাশ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন আনিছুর রহমান লয়েট, পৃষ্ঠা ১৪৪, মূল্য : ৩০০ টাকা। গ্রন্থটির সূচিতে ছোট বড় ২৭টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত। বিভক্ত অংশগুলো হলো জীবন-কথা, সমকালীন পরিবেশ-পটভ‚মি, জন্ম ও বংশ পরিচয়, জীবন-দর্শন, পরিবার-পরিচিতি, শৈশবকাল, বাল্যজীবন, শিক্ষাজীবন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেশবন্ধুর সাহচার্য, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মূল্যায়ন, কর্মজীবন, সাময়িকপত্র সম্পাদনা, সামাজিক সংগঠনে সংশ্লিষ্টতা, সমাজসেবা, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ও বেঞ্চকোর্টেও সদস্যরূপে, সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা, সমকালে কতিপয় ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য, কতিপয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সমকালীন প্রতিক্রিয়া, স্মৃতিরক্ষা ও স্বীকৃতি, জীবনপঞ্জি, রচনা-নিদর্শন, চিঠিপত্র, শেষজীবন ও মৃত্যু, মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখালেখির তথ্য ও আলোকচিত্র।

এ গ্রন্থ পাঠ করে একজন মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারকে খোঁজে পাওয়া যাবে। বইয়ে তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় সব উল্লেখযোগ্য ঘটনাই লেখক তুলে এনেছেন। তাঁর জন্ম, পরিচয়, লেখাপড়া, রাজনীতি প্রভৃতি সবকিছুই আলোচিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর লেখালেখিসহ খুঁটিনাটি প্রায় সবই তুলে এনেছেন সুন্দরভাবে। গ্রন্থটির বিভিন্ন অংশে সমকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে। এই বইতে তাঁর লেখা ‘আসামের জঙ্গলে’ ভ্রমণকাহিনির সংকলিত সংক্ষেপিত অংশ চয়ন করা হয়েছে। এটি একটি ক্লাসিকতুল্য ভ্রমণকাহিনি।

মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার রাজনীতিবিদ হিসেবেই সুপরিচিত। কিন্তু এই বই পড়লে পাওয়া যাবে রাজনীতি সত্তার বাইরে তাঁর আরেক বিস্তৃত লেখালেখির জীবন। তাঁর শৈল্পিক মনন, সাংস্কৃতিক জীবন, শিল্প ও সংস্কৃতি, খেলাধুলা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন- সবই আলোকপাত করা হয়েছে। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার সর্ম্পকে আগ্রহীরা যে কেউই তাঁর হস্তাক্ষর লেখা ছড়া পড়ে প্রীত হবেন। তাঁর অনেকগুলো দুর্লভ ছবি, চিঠিপত্র, মূল্যবান স্মারক বইটির তাৎপর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের জীবন-কর্ম অবদান পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধিকরণে বইটি থেকে পাঠক সমাজ জানতে পারবেন।

লেখক : গবেষক
sharmin.ru71@gmail.com