চর নলসন্ধ্যা গ্রামের লড়াকু নারী লাভলী

গরুর পরিচর্যা করছেন লাভলী বেগম। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

:বজলুর রহমান :
গ্রামের নাম চর নলসন্ধ্যা। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত সিরাজগঞ্জ জেলার সীমানা ঘেঁষা যমুনা নদী দ্বারা বেষ্টিত একটি চরাঞ্চল। এই চরাঞ্চলবাসীর জীবনমান সমতল ভূমিতে বসবাসরত সাধারণ মানুষের মত নয়। তারা প্রতিনিয়ত যমুনা নদীর সাথে সংগ্রাম করেই জীবনযুদ্ধে টিকে রয়েছেন। তাদের অনেকেরই এক সময় শত শত কাঠা জমি ছিল, ছিল গোয়াল ভরা গরু, গোলাভরা ধান, কিন্তু যমুনা নদী তার ভাঙাগড়ার খেলায় তাদেরকে নিঃস্ব করেছে। অনেকে হয়েছেন পথের ফকির। কেউ হয়েছেন দেশান্তরী, আবার কেউ কেউ একাধিকবার বাড়ি সরিয়ে চরেই নিজের ঠিকানা খোঁজে ফিরছে।

এই গ্রামের সিংহভাগ মানুষই নিম্নবিত্ত শ্রেণির। তাদের অধিকাংশই শ্রমজীবী। দিন মজুরী করেই এদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এখানে নারী-পুরুষ উভয়েই মিলেমিশে ক্ষেতে-খামারে এবং গৃহস্থলীর কাজ করেন। গ্রামের রাস্তা-ঘাটগুলো কাঁচা এবং খানা-খন্দকে ভরা। এখানকার বাড়িগুলো একটা থেকে অন্যটা বেশ দূরে।

সম্প্রতি (গত ৩ ডিসেম্বর) ২০ জন সাংবাদিক ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে গণমাধ্যম ও যোগাযোগ উন্নয়ন সংগঠন সমষ্টি আয়োজিত সাংবাদিকদের জন্য চরাঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ক এক প্রশিক্ষণের মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরির জন্য একটি দল চর নলসন্ধ্যা গ্রামে গিয়েছিলাম।

আমাদের বহনকারী নৌকা যখন কাঠালবাড়ী ঘাটে ভিড়ল তখন ঘড়ির কাটা বেলা ১১টা ছুঁই ছুঁই করছে। আমরা সেখান থেকে যমুনার বিস্তৃর্ণ বালুরাশির মধ্যে ভাড়ায়চালিত মোটরবাইকে করে চর নলসন্ধ্যা গ্রামে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর। সদর রাস্তা ধরে কিছুদূর এগুতেই পশ্চিম পাশে লাভলী বেগমের বাড়ি। দুর্গম নিভৃত পল্লী প্রকৃতির নির্জনতায় ছোট্ট একটা শান্তির নীড় যেন লাভলী বেগমের বসতভিটা। বিচিত্র গাছপালা আর পাখির কুজনে মুখর বাড়ির আঙিনায় ঢুকতেই ৩২ বছর বয়সী লাভলী বেগম সালাম দিয়ে পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় জানালে সবিনয়ে বসতে বললেন।

শ্যামলা বর্ণের মাঝারি গড়নের লাভলী বেগম কোন প্রকার জড়তা বা ইতস্ততা প্রদর্শন না করে প্রশ্ন করেন- আপনারা কী জন্য এসেছেন, আপনার সাথের আপাও কি সাংবাদিক? বললাম হ্যাঁ, তিনিও সাংবাদিক। বললাম- আমরা আপনাদের খোঁজ-খবর নিতে এসেছি। সহজ সরল ভাষায় লাভলী বেগম বললেন, কী জানতে চান? বললাম আপনার কত বছর আগে বিয়ে হয়েছে। ১৫ বছর আগে। জানালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলাম, তখন আপনার বয়স কত ছিল? লাভলী বেগম কালবিলম্ব না করে জবাব দিলেন ১৪/১৫ বছর। এ বয়সে মেয়েদের বিয়ে হওয়া নিষিদ্ধ সেটা কি আপনি জানেন? লাভলী বেগম জানালেন, পিতা-মাতার সিদ্ধান্তে বিয়ে হয়েছে। দাম্পত্য জীবনে আপনি সুখী? বললেন হ্যাঁ।

ক’জন সন্তান আপনার। বললেন, ২ ছেলে। তিনি জানালেন একজন ক্লাস নাইনে, অন্যজন ক্লাস সিক্সে পড়ে। আপনার স্বামীর নাম? তিনি বললেন, সুলতান মিয়া। তিনি জানালেন, তার স্বামী একজন রাজমিস্ত্রি। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা জেলায় কাজ করছেন। আপনি কি কোন কাজ করেন? এর জবাবে তিনি বললেন, স্বামীর সামান্য আয়ে সংসার চলে না, তাই ঘর সামলানোর পাশাপাশি আমিও ক্ষেতে-খামারে কাজ করি। স্বামীর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ২ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছি। ভুট্টার ক্ষেত নিরানি থেকে শুরু করে যাবতীয় পরিচর্যা তিনি নিজেই করেন বলে জানালেন।

তিনি বলেন, গত বছর একই জমিতে ভুট্টার আবাদ করে একশত মণ ফলন হয়েছিল, যা ১২শ’ টাকা মণ দরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। বর্তমানে প্রতি মণ ভুট্টা ১৮/১৯শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবার প্রায় ২ লাখ টাকার ভুট্টা বিক্রি করতে পারবো ইনশা-আল্লাহ। তিনি আরও জানালেন, গত বৈশাখে ৩৫ হাজার টাকায় একটি দেশী ষাঁড় বাছুর কিনে চারমাসের মাথায় তা ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এ সময় ষাঁড়ের পেছনে খাদ্য ক্রয়ের খরচ বাদে তার ১৩ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল।

লাভলী বেগম জানালেন, গরু বিক্রি এবং গতবারের ভুট্টা বিক্রির অর্থে গত দুই মাস আগে ৭৫ হাজার টাকায় এক বছর বয়সি বেলজিয়াম জাতের একটি বকনা বাছুর কিনেছি। ১৬-১৮ মাস বয়সে বাছুরের পেটে বাচ্চা আসার কথা। বাচ্চা প্রসবের পর এই গাভী থেকে প্রতিদিন ৮-১০ লিটার দুধ পাওয়ার আশা করছেন তিনি। এছাড়া গত ৫০ দিন আগে তিনি ২০ টাকা দরে ৪০টি দেশি মুরগির বাচ্চা কিনে বাড়িতে একটি মুরগির খামার করেছেন। সেখান থেকে ইতোমধ্যেই তিনি ২০০ টাকা করে আটটি মুরগি ১৬শ’ টাকায় বিক্রি করেছেন। এসব কাজে তার দুই ছেলেও তাকে সহযোগিতা করে বলে জানালেন তিনি। এভাবেই জীবনের লড়াইয়ে জয়ের পতাকা হাতে এগিয়ে চলেছেন লাভলী।

ভুট্টা ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করছেন লাভলী বেগম।ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

আবেগ তাড়িত হয়ে লাভলী বেগম বলেন, দুই বছর আগেও তার সংসারে অভাব অনটন ছিল। স্বামী উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পরও বাচ্চাদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়া দূরে থাক দুবেলা আহার যোগানোই কষ্টকর ছিল। মাংস, দুধ, ডিমের মত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার ছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু স্বামীর পাশাপাশি আমিও যখন সংসারের উন্নতির জন্য নিজে ক্ষেতে-খামারে কাজ শুরু করলাম, তখন থেকে ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে। এখন বাচ্চারা পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে। ভালো পোশাক পরতে পারছে। সংসারে আস্তে আস্তে সুখ-স্বাচ্ছন্দ উঁকি দিচ্ছে।

লাভলী বেগমের সাথে কথা বলে তার সপ্রতিভ স্বভাবে বুঝা গেল তার ভেতরে রয়েছে লড়াইয়ের আগুন। যে আগুন জ্বালিয়ে দারিদ্র্যনাশী লাভলী স্বপ্ন দেখছেন আপন সংসারকে সাজিয়ে গুছিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ এক শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর। যে দারিদ্র্যের কষাঘাত মোকাবেলায় প্রিয় জীবনসঙ্গী তার স্বামীকে থাকতে হয় রোজগারের উদ্দেশ্যে তার কাছ থেকে অনেক দূরে। দারিদ্র্য ঘুচিয়ে স্বামীকে সে কাছে পাবে প্রতিদিন এমন আশা তার। সেই আশার স্বপ্ন বুকে নিয়ে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন লাভলী। ইতোমধ্যেই সাফল্যের পথ পেরিয়ে চলেছেন। তার ভাষ্য, আমরা লেখাপড়া না শিখে যে ভুল করেছি। আমার সন্তানদেরকে সে ফাঁদে পা ফেলতে দিব না। আমার সাধ্য ও সামর্থের সবটুকু দিয়ে হলেও আমার সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করার চেষ্টা করবো। তারা যেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। বড় হয়ে তাদেরকে যেন মা-বাবার মত কষ্ট সহ্য করতে না হয়।

নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন, সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস, যমুনা নদীর সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার প্রেরণা, নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন, সর্বোপরি সংসারে সুখ আনতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই সমান অবদান রাখার পথ যারা লাভলী বেগমকে দেখিয়েছেন এবং শ্রমজীবী নারী হতে যারা তাকে সহযোগিতা করেছেন তারা ‘মেকিং মার্কেটস ওয়ার্ক ফর দি চরস (এমফোরসি)’ এ কর্মরত ভাইয়েরা। তাদের পরামর্শ এবং সহযোগিতার কথা তিনি কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালে এমফোরসি এই চরে তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। মাত্র দুই থেকে আড়াই বছরে আমার মত অনেকেই তাদের সান্নিধ্যে এসে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই গ্রামের অধিবাসীদের জীবন যাত্রার মান আর দশটি গ্রামের মত নয়। প্রতিনিয়ত যমুনা নদীর সাথে যুদ্ধ করে তারাও সংগ্রামী হয়ে উঠেছেন। তাদের মননে চিন্তনে অনুচিন্তনের যে চেতনা সেটা কেবল তাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত। তারা আজ নিছক ভাগ্যের ওপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে চান না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চরাঞ্চলবাসী তাদের প্রতিটি হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করে নিজেদের অবস্থার পবির্তন করার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারেও তারা অবদান রাখতে চান। চর নলসন্ধ্যা গ্রামের মানুষের দারিদ্রের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ যাত্রার অবসান হোক, স্বপ্ন পূরণ হোক লাভলীর।