নকলা হাসপাতালে ওটি আছে অপারেশন নেই

সার্জারি চিকিৎসক ও অ্যানেসথেসিওলজিস্টের অভাবে চালু হচ্ছে না নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপারেশন থিয়েটার। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

শফিউল আলম লাভলু, নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি
বাংলারচিঠিডটকম

দেশের অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে জনবল না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। যন্ত্র আছে কিন্তু সেই যন্ত্র চালানো বা ব্যবহার করার মানুষ নেই। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় আধুনিক ডিজিটাল হাসপাতাল। কিন্তু ভিতরে অনককিছুই ফাঁকা। বলছি শেরপুরের নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কথা। ২০১০ সালে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নতি হয়েছে। হয়েছে নতুন ভবন। জনবল একই রয়ে গেছে। জানা গেছে, ৩১ শয্যার জনবল দিয়ে ৫০ শয্যা হাসপাতাল চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ. গোলাম মোস্তফা। হাসপাতালটিতে রয়েছে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত অপারেশন থিয়েটার। জনবল সংকটে অপারেশন বন্ধ। সার্জারি চিকিৎসক ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট (অবেদনবিদ) থাকলে সিজারিয়ান অপারেশন ছাড়াও অন্যান্য অপারেশন হতো। তাই একজন সার্জারি চিকিৎসক ও অ্যানেস্থেসিস্টের অভাবে চালু হচ্ছে না অপারেশন থিয়েটার (ওটি)। অযত্নে নষ্ট হচ্ছে অপারেশন থিয়াটারের যন্ত্রপাতি। নষ্ট হওয়ার পথে সরকারি লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সেবাটা পেতো। ওই সেবা না থাকার ফলে বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে জেলা না হয় বিভাগীয় শহরে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগী ও তার পরিবার। ছোট খাট অপারেশন ও সেলাই ছাড়া অন্য কোন অপারেশন করা সম্ভব হয় না এই হাসপাতালে।

কর্মরত চিকিৎসকরা এ প্রতিবেদককে বলেন, জনবল সংকটের কারণে নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোগীদের আমরা চিকিৎসাসেবা দিতে পারছি না। পরিস্থিতি এমন যে, হাত-পা বেঁধে আমাদের বলে সাঁতার কাটো। এই অবস্থা হলো এই হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার। নির্ধারিত পদে জনবল থাকলে পুরো উপজেলার করোনাসহ সার্বিক চিকিৎসাসেবার আমূল পরিবর্তন হয়ে যেতো। নকলার মানুষ পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা পেতো। এই হাসপাতালে অ্যানেসথেসিয়া করার চিকিৎসক নেই। অথচ শুধুমাত্র একজন অ্যানেসথেসিয়া ও সাজারি করার চিকিৎসক থাকলে মাসে ৮/১০ সিজারিয়ান অপারেশন করা সম্ভব হতো। সেবা না পেয়ে রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিকে যাচ্ছে। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশন করতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। দরিদ্র রোগীরা এই চিকিৎসাসেবার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে হচ্ছেন সর্বশান্ত।

গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফরা। ২০২০ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৬১৬টি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। এ অঞ্চলের গর্ভবতী মায়েরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নরমাল ডেলিভারিতে আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। একদিকে যেমন খরচ থেকে বাঁচলেন অন্যদিকে প্রসবকারী মা থাকছেন সুস্থ। এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসব করতে প্রসূতিদের উদ্বুদ্ধ করছেন। হাসপাতালে নিরাপদে এ ডেলিভারি করানো হলে মৃত্যুর ঝঁকি কম থাকে, পাশাপাশি কোনো প্রকার অর্থও ব্যয় হয় না।

এই উপজেলায় দুই লাখের বেশি মানুষের বসবাস। বিশাল জনগোষ্ঠীর ৩১ শয্যার জন্য মুঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ছিল ১৭১, শূন্য রয়েছে ১৯টি পদ। তার মধ্যে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ও ৪ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট এর মধ্যে একজনও নেই। ডেন্টাল সার্জন থাকার ফলে দাঁতের প্রাথমিক চিকিৎসাসহ মাইনর অপারেশনের সেবাগুলো পাচ্ছে রোগীরা। ফার্মাসিস্ট ৩ জনের মধ্যে রয়েছে ২ জন, স্বাস্থ্যসহকারী ৪০ জনের মধ্যে রয়েছে ৩৫ জন। ওই জনবল দিয়েই চলছে ৫০ শয্যা হাসপাতাল। ৫০ শয্যা হাসপাতালের জন্য ১ম শ্রেণির জনবলে ৬ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট ও নবসৃষ্ট আইএমও, ইএমও, অ্যানেসথেটিস্ট, এমও ও সহকারী সার্জনের পদের মধ্যে একজনও নেই। ৩য় শ্রেণির প্রধান সহকারী, নবসৃষ্ট ডাহসাব রক্ষক, এমটি (ল্যাব), এমটি (ফিজিও), কার্ডিওগ্রাফী, কম্পাউন্ডার ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ সহকারীসহ ৪র্থ শ্রেণির ৭টি পদের মধ্যে সবই শূন্য রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে রোগীরা পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। উপজেলার ওয়ার্ড পর্যায়ে ২৪টি কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক আছে। এই উপজেলায় করোনা আক্রান্তের হার ১৮.০৭%। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আইসোলেশন বেড আছে ২০টি। ৪০ থেকে ৫০ ধরনের ওষুধ সরকার থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে ইনডোর ও আউট ডোরের রোগীদের। নকলা থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নেওয়া হতো ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এলাকাবাসী ও রোগীর পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প. কর্মকর্তা ডা. রবিউল আক্রাম সরকারি নির্ধারীত ১ হাজার ১৯০টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেন এবং হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গাতে নির্ধারীত ভাড়ার পোস্টার লাগিয়ে দেন। বর্তমানে সরকারি ভাড়ায় রোগী নেওয়া আসা করা হয়। জরুরি বিভাগে একজন মেডিক্যাল অফিসার (কলে), একজন উপসহাকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার ও একজন ওয়ার্ডবয়। এরাই ইমার্জেন্সি চালান। মাঝে মাঝে খাবারের মান নিম্নমানের হয় বলে রোগীরা অভিযোগ করেন।

৫০ শয্যা হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনোলোজির (এমটি) পদের সংখ্যা ৩ জন। আছে আবু কাউছার বিদ্যুৎ ও মুঞ্জুরুল ইসলাম নামে ২ জন। দুই জনের মধ্যে মুঞ্জুরুল ইসলাম ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেপুটেশনে চলে গেছেন। একজনকেই পালন করতে হচ্ছে হাসপাতালে আসা সকল রোগীদের টেস্ট। করোনার জন্য হিমশিম খাচ্ছে। একদিকে নমুন সংগ্রহ আবার তা ময়মনসিংহের পিসিআর ল্যাবে পাঠানো সব দায়িত্ব একার। ব্যাহত হচ্ছে সেবা।

মেডিক্যাল টেকনোলোজিস্ট আবু কাউছার বিদ্যুৎ এ প্রতিবেদককে জানান, তিনজনের কাজ একা করতে হচ্ছে। করোনায় বেড়েছে দায়িত্ব, বেড়েছে কাজ। কাজ করতে করতে মানুষ থেকে যন্ত্রে পরিণত হওয়ার পথে। ৫০ শয্যা হাসপাতালে একা আমিই। হাসপাতালে আসা প্রতিদিনের মত রোগীদের সেবা দিয়ে হাসপাতাল ও বাইরে করোনার নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। তবে এখন যদি প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন রোগীকে প্যাথলোজি টেস্টের সেবা দিতে পারি, যদি জনবল থাকতো তাহলে ১৫০ জনকে ওই সেবা দিতে পারতাম। উপকৃত হতো নকলাবাসী। তারপরেও আমার স্বাধ্যমত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবার সার্বিক অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি আছে। কিন্তু জনবলের অভাবে রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না। তবে আমরা সাধ্যমতো সর্বাত্মক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সেবাকে বৃদ্ধির জন্য হাসপাতালে লাগানো হয়েছে সাউন্ড সিস্টেম ও নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। জনবল ও অপারেশন থিয়েটার চালুর বিষয়ে আমি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছি। তারা আশ্বস্ত করছেন সমস্যাটি নিরসন করবেন। আর আমরা জনবল পেলেই উপজেলাবাসীকে শতভাগ সেবা দিতে পারব।