জামালপুরে পরিবর্তনের ধারায় সম্পৃক্ত হিজড়াদের অভিমত ‘আমাগো কাম দ্যান হাত পাতমু না’

হিজড়াদের বিভিন্ন আয়মুখী কার্যক্রম পরিদর্শন করেন উন্নয়ন সংঘের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচালক জাহাঙ্গীর সেলিম।ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাংলারচিঠিডটকম: ‘আমাগো কাম দ্যান, হাত পাতমু না, মাইনসেরে বিরক্ত করমু না, নিজেরাও অপমানিত অমু না, অন্যরেও জ্বালামু না নিজেরাও জ্বালামু না, উন্নয়ন সমিতির ট্যাহা নিয়া বেবসা শুরু কইরা লাভ বাইর করতাছি’ সরকার আমাগোরে বালা কাম দেক।’ এসব আবেগ আর সুদীর্ঘ কালের না বলা কষ্টের কথাগুলো অবলিলায় প্রকাশ করলেন জামালপুরে বসবাসরত বেশ কয়েকজন হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য।

৩ আগস্ট বিএসআরএম এর আর্থিক সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন সংঘের বাস্তবায়নাধীন হিজড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম সরেজমিনে দেখতে গিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় সম্পৃক্ত হওয়া কয়েকজন হিজড়া বা রূপান্তরিত মানুষের সাথে কথা বলে তাদের অভিমত জানা যায়।

জামালপুর পৌরসভাধীন কম্পপুর, হাটচন্দ্রা, চন্দ্রা ও কাজির আখ এলাকায় বৈশাখী, সাজু, কাজল, আনজু ও হাই হিজড়ার শুরু করা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসার কার্যক্রম দেখে এবং তিনমাসে তাদের ব্যবসা থেকে লাভের কথা জানতে পেরে ভীষণ ভালো লেগেছে।

হিজড়াদের বিভিন্ন আয়মুখী কার্যক্রম পরিদর্শন করেন উন্নয়ন সংঘের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচালক জাহাঙ্গীর সেলিম।ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

হাটচন্দ্রা মিয়াবাড়ি বাজারে সাজু শিশুদের পোষাক ও ইস্ত্রি বসিয়ে ভালোই আয় করেছে। তিনি বলেন, গত ঈদে একরাইতে ১৫ হাজার ট্যাহার মাল বিক্রি করছি। উন্নয়ন সংঘ থাইক্যা ২৫ হাজার ট্যাহা নিয়্যা দুইমাসে ১৩ হাজার ট্যাহা লাভ করছি।

কম্পোপুরে বৈশাখী ১৮ জোড়া কবিতর ও ১০ জোড়া মুরগি কিনে পালন করে বাচ্চা ও ডিম বিক্রি শুরু করেছে। সে ভিক্ষাবৃত্তি না করে এসব পালন করার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে আয় করেন।

চন্দ্রার কাজল উন্নয়ন সংঘ থেকে ঋণ নিয়ে নকশিকাঁথা ব্যবসায় টাকা খাটিয়েছে। সে হিসেবের খাতা দেখিয়ে বলেন, আমি দুইমাসে ১২ হাজার টাকা লাভ করছি।

আনজু হিজড়া বলেন, আমি টাকা নিয়্যা শেরপুর থনে কাপড় কিনে আইনে বাড়ি বাড়ি ঘুইরা ঘুইরা বেচি। দুইমাসে খরচ বাদে ১২ হাজার ট্যাহা লাভ করছি। আনজু এ ব্যবসার পাশাপাশি নাচ, গান করে এবং রাধুনীর কাজ করে বাড়তি আয় করে থাকে।

কাজির আখের হাই একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ। হিজড়া হলেও সে কখনোই কারো কাছে হাত পাতেন না। নকশিকাঁথার ব্যবসা করেই ভালোই করছেন। তিনি বলেন, বালা কাম পাইলে কেহই ভিক্কা করবো না। সরকার অন্যগরে যে সুবিদে দ্যায় আমাগো দিলে আর লজ্জাজনক কাম কেহই করবো না।

হিজড়াদের বিভিন্ন আয়মুখী কার্যক্রম পরিদর্শন করেন উন্নয়ন সংঘের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচালক জাহাঙ্গীর সেলিম।ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

এ ব্যাপারে উন্নয়ন সংঘের মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচালক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, সমাজে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী হিজড়াদের আত্মকর্মসংস্থান, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের বৃহত্তম স্টিল কোম্পানী বিএসআরএম এর আর্থিক সহায়তায় উন্নয়ন সংঘ জামালপুরে ২৫০ জন হিজড়া সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই আশাব্যঞ্জক সাড়াও পাওয়া গেছে। উন্নয়ন সংঘ থেকে বিভিন্ন ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ পেয়ে বিনাসুদে প্রথম পর্যায়ে ৫৩ জন ঋণ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন আয়মুখী কাজে টাকা খাটিয়ে তারা সুফল পাচ্ছে এবং নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে।

উন্নয়ন সংঘের প্রকল্প ব্যবস্থাপক লিটন সরকার বলেন, হিজড়াদের আচরণ পরিবর্তন, বৈষম্য দূর করে সরকারি, বেসরকারি সেবাগ্রহণে সহজলভ্যতা বা সেবা প্রতিষ্ঠানে সহজ প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের বিভিন্ন আয়মূখী কাজের সাথে সম্পৃক্ত করে ক্ষমতায়ন সৃষ্টি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। উন্নয়ন সংঘই প্রথম বিনাসুদ এবং দুই মাসের গ্রেস প্রিরিয়ড দিয়ে ঋণ প্রদান করেছে। তারা আয়মুখী কাজে যুক্ত হওয়ায় আনেকেই এখন যানবাহনে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পেতে সাহায্য নেওয়া থেকে বিরত হয়েছে। যদিও সংখ্যাটা এখন অল্প। আমরা আশা করছি আমাদের কাজের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ভবিষ্যতে হিজড়াদের ‘উৎপাত’ বন্ধ হবে। তারাও উন্নয়নের মূলস্রোতধারায় যুক্ত হবে।

কথা বলে জানা যায় তাদের ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গ সম্বোধনের চেয়ে হিজড়া বলে ডাকলে খুশি হয়। যদিও ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।