কাজী নজরুল ইসলাম শুধু কি বিদ্রোহেরই কবি?

কাজী নজরুল ইসলাম

রাফিউল ইসলাম ::

বহু বছর আগে প্রায় প্রতিবছর একবার ঢাকায় বেড়াতে আসতাম। ঢাকার কিছু মানুষ যখন কথা প্রসঙ্গে জানতে পারতো আমার বাড়ি জামালপুরে, তখন কেউ কেউ এমন কথা বলতো, ‘ওহ খুব ভালো তো, জামালপুরের মানুষেরা অনেক কাজের হয়।’ মনে মনে একটু খুশিই হতাম, গর্বিতও। অনেক বছর পর বুঝতে পারি তারা তাদের বাড়ির কাজের লোকদের কথাই ভদ্রভাবে আমাকে বলেছে। এতো আগের এই সামান্য কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু সম্পূর্ণই অন্য এক প্রসঙ্গে এই কথা কখনোই পুরোপুরি ভুলতে পারিনি। প্রশংসার চালে ভর্ৎসনা আমাদের মার্জিত, শিক্ষিত আর আধুনিক সমাজের প্রায় দ্বিতীয় ভাষা।

রাফিউল ইসলাম

আবারো মে মাসের ২৪ তারিখ এসে গেলো। অনেকেই টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, সভা এবং আলোচনায় নজরুল ইসলামের নামের আগে বিদ্রোহী কবি কথাটা যোগ করবেন। অনেক বড় ডিগ্রিপ্রাপ্ত পন্ডিতগণ অনেক ভালো ভালো কথা বলবেন। অনেকেই অনেক অনুষ্ঠানে নজরুলগীতি গাইবেন। বহু বছর হলো এমনিই তো হয়ে আসছে।

নজরুলগীতি। মনে নেই ঠিক কবে থেকে শুনছি। হয়তো হিস্ মাস্টার্স ভয়েস (His Master’s Voice) গ্রামোফোনে যা আমার বাবা, অন্য এক নজরুল ইসলাম, প্রতি সকালে কোর্টে যাবার আগে যখন শুনতেন অথবা শনি-মঙ্গলবার বিকেলের বাজারের পাহাড়ি সালসার ওষুধের প্যান্ডেলের গানের মাইকে শচীন দেব বর্মনের কণ্ঠে। বাড়িতে রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ডও ছিল বেশ কয়েকটা। প্রায় সেই সময়েই ঢাকার শিক্ষিত আর মার্জিত লোকজনের মুখে জামালপুরের লোকের প্রশংসা শুনে যেমন তাদের ভেতরের ভাব বুঝিনি, ঠিক তেমনি লোকের কাছে নজরুলের গান কেন গীত, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান কেন সংগীত, এই কথাটাও ঠিক আঁচ করতে পারিনি।

গীত আর সংগীতের ভেতর পার্থক্য আদৌ কিছু আছে কিনা তা তখনকার কিন্ডারগার্টেনে পড়া আমি আর কী বা বুঝবো? নজরুলের গানের কথা, মুগ্ধ করা বিচিত্র সব আঙ্গিক, মনকাড়া সুর, বাদ্যযন্ত্রের কাজ আর তার সাথে নৃত্যের সম্পৃক্ততা ও সামঞ্জস্যের সত্ত্বেও কোনো এক কারণে আমাদের একটি শ্রেণির কাছে নজরুলের গান এখনো শুধুই গীত হয়েই আছে। এমনটাই যেন মনের ভাব যে, সংগীত হলো পরিপক্ক, শিক্ষিত, মার্জিত সমাজের জন্য আর গীত যেন একটু অপরিপক্ক, তাতে মিশে আছে একটু মূর্খতার গন্ধ, কিছুটা গেঁয়ো, একটু মলিন, ঠিক তখনকার জামালপুরের মতো।

নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলে আমরা একটা বিশেষ ক্যাটাগরিতে রেখেছি আর তাও সেই ভদ্র সমাজের প্রদত্ত শিক্ষার ফলে। এতে করে যা হচ্ছে, আমাদের নতুন প্রজন্ম এই ভেবে বড় হচ্ছে যে, নজরুল শুধুই বিদ্রোহেরই কবি। যে কবি বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি ভাষায় এতো গান আর কবিতা লিখেছেন, ইসলামিক আর হিন্দু ধর্মের এতো ভক্তির গান আর কবিতা লিখেছেন, এতো সুর ব্যবহার করে প্রেমের গান, দেশের গান, ধর্মের গান আর কবিতা লিখেছেন, তাকে শুধুমাত্র একটা শ্রেণিতে আখ্যায়িত করা আমাদের কেমন বিচার? এটা তেমন কোনো অবিচারও বলতে পারতাম না, ছেড়েই দিতাম যদি না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা বিশ্বকবি বলে না চিনতাম। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ উনার গানের বিষয়ে এতটাই রক্ষণশীল ছিলেন যে পঙ্কজ মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস আর দুই একজন ছাড়া কাউকেও নিজের গান গাওয়ার অনুমতি দেননি। অন্যদিকে, নজরুল নিজের গান শচীন দেব বর্মন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, কে সি দে, মান্না দে, সুধীন দাস, কমল দাশগুপ্ত, সন্ধ্যা মুখার্জী, মুহাম্মদ রাফিদের মতো অনেক শিল্পীকেই নিজে গান ট্রেইন করে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গাইয়েছেন, গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড করিয়েছেন।

নজরুল বাংলা গানের পৃথিবী খুলে দিয়েছেন সবার জন্য সেই সময়ে যখন সংস্কৃতি ছিল রক্ষণশীল, সংকীর্ণ আর শুধুমাত্র উচ্চ শ্রেণির বিলাসিতার বাহন। হয়তো সে কারণেই তখন থেকেই আমরা নজরুলকে আর তার গানকে গীত বলেই ছোট করার চেষ্টা করে আসছি। যে মানুষটা গান আর কবিতার চর্চা সবার মাঝে নির্দ্বিধায় গণতান্ত্রিক করার চেষ্টায় নিজের কর্মজীবন উৎসর্গ করলো তাকে আমরা শুধুই তার কিছু বিদ্রোহের গান আর কবিতার জন্যই স্মরণ করি। আর সেই নামেই তাকে ডাকি। অন্য দিকে বিশ্ব কবি হলেন তিনি, যিনি নিজের গান দুই একজন ছাড়া অন্য কাউকেও গাইবার অনুমতিও দেন নাই।

নজরুলের প্রশংসা কবিগুরু নিজে প্রাণখুলে করতেন আর নজরুলের ভক্তি ঠাকুরের জন্য ছিল অসীম। তিনি বিশ্ব কবি বা ভারতীয় কবি না বাংলার কবি এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন চিন্তাযুক্ত ছিলেন না, তেমনি বিদ্রোহী না প্রেমের কবি এই নিয়ে নজরুল কখনো সামান্য উক্তি করেন নাই। তারা মহান। আর যারা মহান, তারা সর্বদাই মহান। শুধু আমরাই আমাদের নির্বুদ্ধিতা, প্রাণের সংকীর্ণতা, অশিক্ষা আর অন্ধতার বশবর্তী হয়ে পছন্দের একজনকে বড়ো করতে অন্যজনকে ছোট করার চেষ্টা অনবরত করে যাচ্ছি। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে এই সামান্য দুটি কথা না বলে থাকাটা নিজের কাছে অনেকটা অপরাধ বলেই বোধ হচ্ছিল।

# রাফিউল ইসলাম, ডক্টর অফ জুরিসপ্রুডেন্স; বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলারচিঠিডটকম