আমাদের ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে থাকা গবাখাল আজ মৃতপ্রায় : সংস্কার জরুরি

জাহাঙ্গীর সেলিম :

পরিবেশ ও মানবকল্যাণের কথা চিন্তা করে আজ থেকে প্রায় ৬৫ বছর আগে গবাখাল খনন করা হয়। জামালপুর শহরের জলাবদ্ধতা, বন্যার কবল থেকে রক্ষার পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন ও মৎস্য আহরণের লক্ষ্যে ১৯৬০ অথবা ৬১ সালের দিকে টাকার বিনিময়ে কাজের ভিত্তিতে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসন ও পৌরসভার উদ্যোগে ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থ গবাখালটি খনন করা হয়। জামালপুর পৌরসভার শেখেরভিটা থেকে শুরু করে মনিরাজপুর, ছুটগড়, সিংড়িবিল, পলিশা, ধোপাকুড়ি, নাকাটি ও দামেশ্বর হয়ে কেন্দুয়া কালবাড়ি বাজার সংলগ্ন ঝিনাই নদীতে সংযোগ করা হয়।

তিরুথা গ্রামের বাসিন্দা ৭২ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মিয়ার উদ্দিন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ৬২ সালে রেকর্ডের ১/২ বছর আগে থেকে মহকুমা ও পৌরসভা খাল খনন শুরু করে। আমি তখন ছোট। থ্রিতে পড়ি। পার্শ্ববতী খাল খননের খবর শুনে আমরা সহপাঠীরা তামশা দেখতে যেতাম।

পুলিশলাইন সংলগ্ন নার্সারি ব্যবসায়ী জালাল উদ্দিন (৭৪) বলেন, ওই সুময় এত্ত বড় খাল খুদার খবর হুইনে আমরা হগলদিন গিয়ে তামশা দেখতাম। এই খালে আমরা নানা কিসিমের মাছ ধরতাম। কই গেলো দিনগুইলে।

পলিশার মান্নান মাস্টার জানান, আমরা তখন অনেক ছোট। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই খালটি খনন করা হয়। আমার বাপ-দাদার জমিও আছে এই খালে। তবে সরকার আমাদের জমির বদলে টাকা দিছে। এই খালটি আরওআর রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। খালটি এখন ময়লা, আবর্জনা বাগাড় হয়েছে। দূষিত করা হয়েছে। খালটি উদ্ধার ও খনন করা জরুরি।

আমাদের শৈশব থেকে দেখে আসছি এই খালটিতে স্বচ্ছ জলাধার ছিলো। প্রচুর মাছ পাওয়া যেতে। বড়দের সাথে আমি নিজেও স্কুল জীবনে মাছ ধরেছি। বোয়াল, শোল, গজার, বাইম, টেংরা, পুটি, টাকিসহ নানা জাতের মাছের সমাহার ছিলো। কি স্বাদ ছিলো মাছের। আমরা সাঁতার শিখেছি অনেকেই এই খালে। আমাদের জলকেলীতে মেতে উঠা শৈশব এ প্রজন্মের কাছে কল্পনার বিষয়।

জেলেদের জীবিকার যেমন উৎস ছিলো এই খাল তেমনি দুই পাশে শতশত একর জমিতে কৃষি আবাদের জন্য সেচের সহজ ব্যবস্থা ছিলো। কৃষি অধ্যুষিত উল্লেখিত গ্রামগুলোর বাসিন্দারা এ খালটিকে আশীর্বাদ হিসেবেই দেখে এসেছে সুদীর্ঘকাল। এ খাল খননের ফলে জামালপুর শহরে কোনদিন জলবদ্ধা হয়নি। গত দুই দশক আগেও এ খালের পানি প্রবাহ ছিলো বাধাহীনভাবে। শহরবাসী বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত অথবা ১৯৮৮, ৯৮ এর ভায়বহ বন্যার সময়ও শহরের রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকতো না। শহরে এত ড্রেন না থাকলে পানি বের হবার মতো অবাধ জায়গা ছিলো।

কালের বিবর্তনে স্বার্থান্ধ মানুষের লোভের শিকার হয় আমাদের ঐতিহ্য আর কল্যাণময় গবাখালটি। ভরাট আর অবৈধ দখলের কবলে পড়ে শান্তির স্রোতবাহী আমাদের প্রিয় গবাখালটি। দুইপাড়ের অনেক স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে বসতি। পয়নিষ্কাশনের জন্য নিরাপদ মনে করে অনেকেই খালের পাড়ে স্থাপন করেছে পায়খানা। গৃহস্থালী, ক্লিনিকেল, পলিথিন, প্লাস্টিকসহ ক্ষতিকারক ও অপচনশীল বর্জ্য ফেলে খালের পানি দূষণ করা হয়েছে। সর্বশেষ খালের বুকে পেরেক মেরেছে পুলিশ লাইনস সংলগ্ন একটি রঙিন কাগজের মিলে নির্মম আগ্রাসন। ওই মিলের রাসায়নিক তরল পদার্থ নির্গমন করা হয় গবাখালের পানিতে। এখন মাছ তো দূরের কথা কোন জলজজীবের সন্ধান মিলে না খালের পানিতে।

খালটির সূচনা পথই আটকে দিয়েছে স্বার্থপর মানুষ। শহরের পূর্বএলাকাসহ উত্তরের পানি এ খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঝিনাই নদীতে পড়তো। এখন শীর্ণধারায় পানির সাথে বিষ নেমে আসে প্রাণের ঝিনাই নদীতে। ফলে নদীও মাছশূন্য এখন।

সম্প্রতি জামালপুরে একাধিক সভায় সদর আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ নদ, নদী, খাল, বিল উদ্ধার ও রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রভাশালী মহলের প্রভাব এবং অনৈতিক দাবির বা আবদারের কাছে আমাদের সৎ ও নির্লোভ সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ কোন মূল্যেই তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুল নড়বেন না বলে আমরা সবাই বিশ্বাস করি।

ফিরে পাক প্রাণ আমাদের গবাখাল। মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াক ইতিহাস, ঐতিহ্যের চেতনায়। আমার পরবর্তী লেখা থাকবে বংশখাল নিয়ে। পাঠকের মতামত ও পরামর্শ পেলে ধন্য ও সমৃদ্ধ হবো।

লেখক: সভাপতি, জামালপুর পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন ও গণমাধ্যমকর্মী।