আজ ২৫শে বৈশাখ কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী : রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোয় একদিন

জোড়াসাঁকোর সামানে লেখক।

জাহিদুর রহমান উজ্জ্বল :

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকো দেখতে কলকাতা গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে কলকাতা গিয়ে প্রথম দিনে ঘুরতে বেরুনোর প্রথম তালিকাটি ছিল ওই বাড়ি। আমি ও আমার সহধর্মিণী দিপালী ও ছোটভাই লিখন ছিল সেই যাত্রায়।

কলকাতার হোটেল সোনারগাঁ থেকে সকালে কাজ শেষে ট্যাক্সি ক্যাবে জোড়াসাঁকোয় গেলাম। অপূর্ব লাল রঙের বিশাল দালান, সাজানো বাগান তোরণ পেরিয়ে পা বাড়াতেই কবিগুরুর ছবি ভেসে উঠলো। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে পড়লো।
এই বাড়িটি দেখার ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। আজ তা পূরণ হচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত জোড়াসাঁকোর গল্প শুনেছি। প্রচুর পড়েছি। কিন্তু বাস্তবে জোড়াসাঁকো দেখবো এটা বিশ্বাস হচ্ছে না।

বিশ্বভারতীর গেট পেরিয়ে সবুজ আঙিনা। গেটের সাথেই টিকিট কাউন্টার। ২০ রুপির টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম ভবনে। নীচতলা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।

রবীন্দ্রনাথের আঁতুড় ঘর থেকে শুরু করে যে ঘরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেটিও আছে সাজানো গোছানো। মোট চারটি ভবনের ১৮টি গ্যালারি জুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। মূল বাড়িটি আয়তাকার। দোতলায় উঠেই হাতের বাম দিকে যে ঘরটি পড়ে সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথের খাবার ঘর, তার সাথেই লাগোয়া মৃণালিনীর হেঁসেল। পাশে সংগীতের ঘর, এর পর মহাপ্রয়াণের ঘর। ১৯৪১-এর ৩০ জুলাই এ ঘরেই কবিগুরু তাঁর শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’-এর ডিক্টেশন দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাতদিন পর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

দু’টি আর্ট গ্যালারিও রয়েছে এই ভবনে, একটি প্রাচ্য আর একটি পাশ্চাত্যের ধারার। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, নন্দলাল বসু-সহ আরও অনেক নামীদামি শিল্পীর আঁকা ছবি আছে এখানে। নোবেল পুরস্কারের গ্যালারিটিও চমকপ্রদ। গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরস্কারের টুকরা-টাকরা গল্প ছাড়াও নাইটহুড বর্জনের কারণ বর্ণনা করে ইংরেজ সরকারকে লেখা পত্রের কপিটিও আছে এখানে।

ঘুরে ঘুরে বিশ্ব ভারতীর জাদুঘরে কবিগুরুর ব্যবহৃত গাড়িটি দেখে চমকে উঠলাম। বাহ্ তখনকার দিনে কবি এরকম একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। গাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে যা জানলাম তা হলো ‘১৯৩৩ সালের হাম্বার’ গাড়িটি সম্ভবত সব থেকে পছন্দের গাড়ি ছিল বিশ্বকবির। রবীন্দ্রনাথ খুব ভালবাসতেন এই গাড়িতে চড়তে। জীবনের শেষদিনগুলিতেও তিনি এই গাড়ি ব্যবহার করেছেন। শুধু তিনিই নন, এই গাড়ির যাত্রীদের তালিকা চমকে দেওয়ার মতো। সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরুর মতো বিখ্যাত মানুষরা এই গাড়িতে চড়েছেন।

১৯৩৮ সালে কনিষ্ঠ পুত্র এবং বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকা থেকে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ফিরেছেন। সেই বছরেই রথীন্দ্রনাথ ১৯৩৩ সালের মডেলের একজোড়া হাম্বার কিনে ফেললেন ‘এইচএইচ লিলি’ নামক হাম্বার গাড়ির ডিলারের থেকে।

এরাই গোটা ভারত এবং বর্মাদেশের একমাত্র ডিলার ছিল। পার্ক স্ট্রিটের শোরুম থেকে কেনা দু’টি গাড়ির প্রত্যেকটি ৪০০ পাউন্ড (তখনকার মূল্যে ৫৩০০ ভারতীয় মুদ্রা) দিয়ে কিনেছিলেন। দু’টি গাড়ির একটি জোড়াসাঁকোতে ছিল, আর একটি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিশ্বভারতীতে।

রবীন্দ্রনাথের শরীর তখন খুব ভাল না থাকলেও রোজ বেশ কিছুটা হেঁটে চলে বেড়াতেন। ঘুরে বেড়াতেন ক্যাম্পাসের ভিতর। এই কারণেই তার জন্য এই গাড়ির ব্যবস্থা করেন রথীন্দ্রনাথ। গাড়িটি পেয়ে বড় খুশি হন তিনি, রোজ একাধিক বার গাড়ি চড়তেন, ঘুরে বেড়াতেন নিজের পছন্দ মতো। সেই সময় এই গাড়ি শান্তিনিকেতনের পথে দেখলেই লোকে বুঝতেন ভিতরে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন, ঘুরতে বেরিয়েছেন। তিনি এই গাড়ির অদলবদল করেছিলেন নিজের প্রয়োজন মতো, শীতলপাটি লাগিয়েছিলেন গাড়ির চারপাশে, যাতে ভিতরে ঠাণ্ডা থাকে।

থমাস হাম্বার ১৮৬৮ সালে নিজের নামে তৈরি করেন হাম্বার কোম্পানি। এই ব্রিটিশ গাড়ির কোম্পানি ধীরে ধীরে এতই বিখ্যাত হয়, পৃথিবীর অন্যতম সেরা গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। এদের অন্যতম সেরা গাড়ি ছিল ১৯৩৩ সালের হাম্বার স্নাইপ এবং পুলম্যান সেডান। ৪ লিটারের ইঞ্জিন ধারণক্ষম এই গাড়ি যে সেই সময়ের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।

১৯৩১ সালে রুটস্ ব্রাদার্স এই সংস্থার বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নেয়। হাম্বার তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। বেশির ভাগ ডিজাইনার, ওয়ার্কার সংস্থা ছাড়েন। কারণ তাদের কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা কমে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই কোম্পানি ১৯৩৩ সালে নিয়ে আসে এই হাম্বার, যা শুধু মার্কেটে তাদের ফিরিয়ে আনে তাই-ই নয়, ব্রিটিশ গাড়ির নামকেও পুরো পৃথিবীর কাছে তুলে ধরে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় এই হাম্বার গাড়িটি এখনও বিশ্বভারতীতে রাখা আছে দর্শনীয় বস্তু হিসাবে।

যাক গাড়ির কথা, জোড়াসাঁকোর ইতিহাসে জানা গেলো, এই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব। যৌবন এবং পরবর্তীকালেও অনেকটা সময় তিনি এই বাড়িতে থেকেছেন। কখনও শিলাইদহ, কখনও শান্তিনিকেতনে বাস করেছেন, কখনও বা ঘুরে-বেড়িয়েছেন দেশে-বিদেশে। কিন্তু বাড়িকে ভুলতে পারেননি। বিশ্বকবির মহাপ্রয়াণ হয় এখানেই।

কলকাতার জোড়াসাঁকোয় অবস্থিত ঠাকুর পরিবারের বাড়িটি এক সময়ে ছিল আধুনিক বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। যাকে সাধারণভাবে ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ বা ‘Bengal Renaissance’ বলা হয়, তার গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান এটি। ১৭৮৪ সালে নীলমণি ঠাকুর এই জমি গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন জিউয়ের নামে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে লাভ করেছিলেন বৈষ্ণবচরণ শেঠের থেকে। তিনি এখানে গড়ে তোলেন ইমারত। অবশ্য তাঁর নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের আমল থেকেই বাড়ির গৌরবময় অধ্যায় শুরু হয়। ঠাকুরবাড়ির রথী-মহারথীদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা।

জোড়াসাঁকোর জমিতে দ্বারকানাথ তৈরি করেছিলেন ‘ভদ্রাসন বাড়ি’, যেখানে ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। সেটি এখন ‘মহর্ষি ভবন’ নামে পরিচিত। ১৮২৩ সালে পাশ্চাত্যের অতিথিদের জন্য দ্বারকানাথ ‘বৈঠকখানা বাড়ি’ নামে আরেকটি ভবন তৈরি করেছিলেন। গিরীন্দ্রনাথ তাতে পরিবার নিয়ে বাস করতেন। গগনেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ সেখানে থাকতেন, শিল্পচর্চা করতেন। পরে ভেঙে ফেলা হয় ভবনটি। ১৮৯৭ সালে ‘মহর্ষি ভবন’-এর পশ্চিমে ‘বিচিত্রা ভবন’ তৈরি করিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

স্বাধীনতার পর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িকে অধিগ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬২ সালে স্থাপিত হয় রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম। বিটি রোডে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মরকত কুঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস গড়ে ওঠে সত্তরের দশকে। জোড়াসাঁকো থেকে বিভিন্ন বিভাগ সরিয়ে নেওয়া হয় সেখানে। গোটা ঠাকুরবাড়ি জুড়েই সংগ্রহশালা গড়ে ওঠে।

মিউজিয়ামে দর্শকদের জন্য রয়েছে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ প্রমুখের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী। শিল্পকলা নিয়ে দুটি গ্যালারি আছে। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত কয়েকটি গ্যালারিও মুগ্ধ করবে। এছাড়াও দেশে দেশে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণের স্মৃতি বহন করছে জাপান গ্যালারি, চায়না গ্যালারি, ইউএস গ্যালারি এবং হাঙ্গেরি গ্যালারি। ব্রাহ্ম সমাজেরও ইতিহাসের পরিচয় এই বাড়িতে পাওয়া যায়। প্রতি বছর এখানে ঘটা করে উদযাপিত হয় বর্ষবরণ, পঁচিশে বৈশাখ।

লেখক: সাংবাদিক।