আওয়ামী লীগের যৌথসভায় প্রধানমন্ত্রী : স্বতন্ত্র-নৌকা বিভেদ ভুলে যাওয়ার নির্দেশ

বাংলারচিঠিডটকম ডেস্ক :

বিভেদ ভুলে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনে কেউ জিততে পেরেছে, কেউ পারেনি। হারজিত যাই হোক সেটা সবাইকে মেনে নিয়ে অন্তত নিজের দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। আমরা যদি একে অপরের দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকি, এটা বিরোধীদের উৎফুল্ল করবে, তাদের সুযোগ করে দেবে।’

সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের যৌথসভায় তিনি এ কথা বলেন। টানা চতুর্থবার সরকার গঠনের পর এই প্রথম ক্ষমতাসীন দলটির যৌথসভা হলো। এতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল বলেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছি। নির্বাচন যাতে না হয়, সে জন্য অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ছিল। তারা লিফলেট বিলি করেছে মানুষ যাতে ভোটকেন্দ্রে না যায়। কিন্তু লিফট যত বেশি বিলি করেছে, মানুষ তত বেশি ভোটকেন্দ্রে গেছে।

তাদের আহ্বানে মানুষ সাড়া দেয়নি। এই যে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস সেটা আমাদের ধরে রাখতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এখন আর কেউ দুর্ভিক্ষের দেশ, ভিক্ষুকের দেশ মনে করে না। এখন সবাই মনে করে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। ’৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে এমন অবস্থায় ছিল যে, তখন বাংলাদেশ বললে তারা মনে করত একটা দুর্ভিক্ষের দেশ, দুর্যোগের দেশ; ওই দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সে সময় কোনো দেশে গেলে বলত বাংলাদেশ তো হাত পাততে আসে। এখন অন্তত এটুকু দাবি করতে পারি, আওয়ামী লীগ সেই ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন আনতে পেরেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এই অফিসে (বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) ঢুকতে দেওয়া হতো না। চারদিকে পুলিশি ব্যারিকেড ছিল। অনেক সময় নেতাকর্মীরা আটকা পড়ত, তখন আমি বাধ্য হয়ে জোর করে ঢুকতাম এবং নেতাকর্মীদের উদ্ধার করতাম। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আমাদের অফিসটা হয়ে গিয়েছিল হাসপাতাল। কারণ বিভিন্ন জেলা থেকে আহত নেতাকর্মীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। নেতাকর্মীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, খাওয়ার ব্যবস্থা আমরা এখানে করেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি আমাকে ’৮১ সালে না ডাকত এবং দায়িত্ব না দিত তাহলে আমি আজকের অবস্থানে পৌঁছতে বা দেশের উন্নতি করতে পারতাম না। কাজেই এই আওয়ামী লীগ অফিসই আমার মূল শেকড়। এখান থেকে আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম সবকিছু শুরু। এই অফিসের সঙ্গে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িত। এজন্য দলের অগণিত নেতাকর্মীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এক সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের সারথি যারা নেই তাদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।’

গত কয়েক দিনে বিভিন্ন কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কর্মীদের নিয়ে গণভবনে বৈঠক করতে পারতাম। কিন্তু না, আমার যেখানে মূল শেকড়, সেখানে আসতেই হবে। সেজন্যই এই অফিসে আগমন।’

নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা নির্বাচন করেছে, তাদের কেউ জয়ী হয়েছে, কেউ জয়ী হতে পারেনি। সেক্ষেত্রে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করা বা কার কী অপরাধ এগুলো খুঁজে বের করা-এসব বন্ধ করতে হবে। আমরা জনগণের যে সমর্থন পেয়েছি সেটা কিন্তু কাজের স্বীকৃতি। দেশের মানুষের জন্য আমরা কাজ করেছি, দেশের মানুষ আমাদেরকে ভোট দিয়েছে, আমাদের জয়ী করেছে।

সেখানে হয়তো কেউ জিততে পেরেছে, কেউ জিততে পারেনি। হারজিত যাই হোক সেটা সবাইকে মেনে নিয়ে অন্তত নিজের দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। আমরা যদি একে অপরের দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকি, এটা বিরোধীদের উৎফুল্ল করবে, তাদের সুযোগ করে দেবে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যে দল নির্বাচন করে না, তারা গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচন করায় অভ্যস্ত না। যেসব জরিপ আন্তর্জাতিকভাবে হয়েছিল তাতে স্পষ্ট ছিল বিএনপি নির্বাচন করলে সরকার গঠন করার মতো সাফল্য অর্জন করবে না। সেরকম সিটও পাবে না। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। আওয়ামী লীগ পর্যাপ্ত সিট পাবে। এ কথা শোনার পর তারা নির্বাচনে আসবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। তাছাড়াও ওদের সৃষ্টি হয়েছিল অবৈধভাবে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তাদের পকেট থেকে। জনগণের ভোট চুরি করা, নির্বাচনে কারচুপি করা, এসব কালচার বিএনপির আমলেই সৃষ্টি।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপির আগের চরিত্র দেখলাম ২৮ অক্টোবর। সেখানে পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশকে পিটিয়ে মেরেছে। ২০১৩ সালে এভাবে মেরেছিল। সেই একই চিত্র আমরা আবার দেখলাম। তারা বলে ওখানে উসকানি দেওয়া হয়েছিল। যে অঞ্চলে পুলিশকে মারল সেখানে আওয়ামী লীগের কেউ ছিলই না। ওরাই পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্সে আক্রমণ করে। গাড়ি পোড়ায়। প্রধান বিচারপতির বাড়ি, জাজেস কোয়ার্টার, সাংবাদিক, কেউ ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

আমাদের মহিলারা মিছিল নিয়ে আসছিল, তাদের ওপর আক্রমণ করে। এই ঘটনা ঘটিয়ে তারা আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে কাঁদে। তাদের মুরুব্বিদের কথামতো আবার কান্নাকাটি করে। তারা বলে সেটা উসকানি, আসলে উসকানিটা দিল কে? উসকানি দেওয়ার মতো তো কেউ ছিল না। পুলিশ তখন যথেষ্ট সহনশীলতা দেখিয়েছে। এরা এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটাবে, ঘটাতেই থাকবে। দুর্নীতি করা আর মানুষ খুন করা, এটাই হচ্ছে বিএনপির চরিত্র।’

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন মানুষের সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে দ্রব্যমূল্য। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আমরা সেটা অনেকটাই কমিয়ে এনেছি। এখানে কিছু কিছু মহল আছে, চক্রান্ত করে মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। তবে এটাও সত্য যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে এতটা ছিল না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সামনে রোজা। এ সময়ে যা যা দরকার তার সবই আগাম কেনার ব্যবস্থা নিয়েছি। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির লাগাম যাতে আরও টেনে ধরা যায়, তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শেখ হাসিনা দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ইশতেহার ও ঘোষণাপত্র ভালোভাবে পড়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, এটা পড়লে আমরা যে আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি তা ভালোভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। সেই মোতাবেক কাজ করতে পারবেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের কল্যাণ আওয়ামী লীগের হাতে। আওয়ামী লীগ এদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। এই আওয়ামী লীগ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ দিয়েছে। সাক্ষরতার হার বাড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা দোরগোড়ায়ে পৌঁছে দিয়েছে। ভূমিহীনদের ঘর করে দিয়েছে।

শিখা অনির্বাণে শ্রদ্ধা : বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সকালে ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তিনি শ্রদ্ধা জানান। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর প্রধানমন্ত্রী সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল এ সময় তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে প্রধানমন্ত্রী শিখা অনির্বাণ প্রাঙ্গণে রক্ষিত দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন।

এর আগে, প্রধানমন্ত্রী শিখা অনির্বাণে পৌঁছলে তিন বাহিনীর প্রধানরা তাকে অভ্যর্থনা জানান। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তিনি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে যান এবং সেখানে নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং তিন বাহিনীর প্রধানরা তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।