অসহযোগের ডাকে খুব একটা সাড়া মিলছে না

বাংলারচিঠিডটকম ডেস্ক :
সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিএনপির ডাকা অসহযোগ কর্মসূচি চলছে। এমন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে দলটি রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়ে চমক সৃষ্টি করতে চাইলেও এতে জনগণের তেমন সাড়া নেই। বিএনপির আহ্বান অনুযায়ী আদালতে হাজিরা না দেয়া বা কর, বিল, খাজনা না দেওয়ার বিষয়গুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে বাস্তবের চিত্র অস্বীকর করে দলটির নেতারা বলছেন, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার সপ্তাহ খানেক পর মানুষের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তাদের দাবি- আদালতে হাজিরা বর্জনসহ কর ও খাজনা দেয়া থেকেও বিরত থাকছেন দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ জনগণ।

বিএনপির ডাকা অসহযোগ আন্দোলন কতটা বাস্তবায়ন হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের অসহযোগ কর্মসূচি দেশের মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে। এর প্রতিফলন চলমান কর্মর্সূচিতেই স্পষ্ট হয়েছে। এ অসহযোগ কর্মসূচির সফলতা অবশ্যই আসবে, তবে হুট করে কিছুই হয় না।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আমরা যখন লিফলেট বিতরণ করছি, তখন উপস্থিত যারাই থাকুক, সবজি বিক্রেতা, রিকশাচালক- তারা যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটা গ্রহণ করছে তাতে মনে হচ্ছে আমাদের অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি, নির্বাচন বর্জনের কর্মসূচিতে তারা পূর্ণ মাত্রায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

গত ২০ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘বর্তমান সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত’ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করা, ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ কিনা তা ভাবা এবং আদালতে মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায় দলটি। একই সঙ্গে কর ও বিভিন্ন সেবার বিল না দেয়ার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
অসহযোগ এবং পরিষেবা বিল কিংবা কর-খাজনার বিষয়ে

সুনির্দিষ্টভাবে বলা হলেও এসব বিষয়ে কিছু কৌশল আছে। যেমন কর্মসূচি ঘোষণাকালে বিএনপির ঘোষণায় জনগণকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো এই অবৈধ সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কিনা সেটি ভাবুন। তবে প্রকৃত তথ্য হলো বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ব্যাংক মালিক-পরিচালকও আছেন। এ ছাড়াও দলের নেতাদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাদের পক্ষে ব্যাংক এড়িয়ে চলা অনেকটাই অসম্ভব। এর বাইরে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীও ব্যাংকে টাকা জমা রাখা থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে কতটা সাড়া দেবেন, সেই প্রশ্ন আছে দলের ভেতরেই।

বিএনপির নেতারা বলেছেন, অসহযোগের সঙ্গে যেসব কর্মসূচি দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কৌশলও আছে। যেমন কর্মসূচিতে সরাসরি ব্যাংকিং কার্যক্রম এড়িয়ে চলতে বা বাদ দিতে বলা হয়নি। বলা হয়েছে- ব্যাংকে টাকা জমা রাখা কতটা নিরাপদ সেটি চিন্তা করতে। আবার গ্যাস, বিদ্যুৎসহ পরিষেবা বিলগুলো ৩ মাস পর্যন্ত জমা না দিলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। এখন ৩ মাস বিল না দিয়ে লোকজন পরে জরিমানাসহ পরিশোধ করার সুযোগ পাবে এবং এতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কর আদায়ের ক্ষেত্রে তারা অসহযোগ আন্দোলনের কোনো প্রভাব দেখছেন না। তিনি বলেন, গতবারের তুলনায় এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি বেশি। সেক্ষেত্রে আমার এখানে অসহযোগ বা ট্যাক্স দিচ্ছে না এরকম মনে হচ্ছে না।

বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু বলেন, আমরা অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে রয়েছি। এ আন্দোলন সফল করতে দলে জোর তৎপরতা রয়েছে। কর্মসূচি ঘোষণার করে বিল, কর, খাজনা বিএনপির নেতাকর্মীরা দিচ্ছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নেতা বলেন, এখনো বিলের কাগজ হাতে পাইনি, আগামী ৩ মাস তো অবশ্যই দেব না। এর পরে যা হয় হবে। কেবল নিজেরাই নই দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের পরিচিত আত্মীয়স্বজন যে যেখানে আছেন সবাইকে বিল ও কর না দিতে বলছেন।

এদিকে, অসহযোগ কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির মাঠের নেতাদের মধ্যে এখনো বিস্ময় কাজ করছে। তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে ভোরের কাগজের কথা হয়েছে। তারা জানান, ‘এই কর্মসূচি অনেকটাই এককভাবে লন্ডন থেকে এসেছে’। তাদের ধারণা ছিল- ধীরে ধীরে এমন কর্মসূচির দিকেই হয়তো দল যাবে কিন্তু সেটি এত দ্রুত ও হুট করেই ঘোষণা করা হবে সেটি তারা ভাবেননি। তাছাড়া বিএনপির সঙ্গে যেসব দল ও জোট অনেকদিন ধরেই যুগপৎ আন্দোলনে আছেন তাদের কেউ কেউ আগে থেকে জানলেও অনেকেই বিষয়টি ঘোষণার পর জেনেছেন।

দলীয় পদ-পদবি থাকায় তারা ‘অন রেকর্ড’ কোনো কথা বলতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে গাজীপুরের একজন বিএনপি নেতা বলেছেন, নেতারা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তারাই বলতে পারবেন। তবে এখনি অসহযোগ না দিয়ে এর আগে সবার কারাবরণ কর্মসূচি দিলে তা বেশি কাজে লাগত। তিনি বলেন, আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী জেলে। আমরাও যেতাম। একযোগে কারাবরণ করতাম। এখন কর খাজনা কিংবা বিল না দিয়ে কয়জন পরিস্থিতি সামলাতে পারবে?

এক সপ্তাহ আগে ঢাকার নিম্ন আদালত ঘুরে দেখা গেছে, অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি নেতাকর্মীর আদালতে হাজিরা না দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও প্রথমে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন অনেকেই। কেউ কেউ হাজিরা দেয়া নিয়ে ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বে’ ভুগছেন। অনেকে আদালতে উপস্থিত না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সময়ের আবেদন করেছেন।

সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ১ থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগসহ সারাদেশের সব আদালত বর্জনের ঘোষণা দেয়। এ সম্পর্কিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামাল এই ৭ দিন আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ, সমস্ত জেলা আদালত, সেশন আদালত, মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, মুখ্য জুডিশিয়াল আদালতসহ সব আদালত বর্জন করার কথা জানান। এর পর থেকে প্রতিদিনই অসহযোগ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আদালত বর্জন কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের আদালত বর্জনের কারণে এক সপ্তাহ পিছিয়ে যায় দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন শুনানি।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, সময়মতোই অসহযোগ কর্মসূচি এসেছে। এ কর্মসূচি ঘোষণার পরে তা বাস্তবায়নে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেও আলাদা কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে। জনগণের সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি ধীরে ধীরে জনগণ সরকারকে অসহযোগিতার এই ‘সিভিল কর্মসূচিটি জোরদারভাবে পালন করবে।

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম খান বলেন, নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেয়ার পরিমাণ কমে গেছে। বেশির ভাগ নেতাকর্মীরাই যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এমনিতেই তাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দেয়া হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আবার দ্রুত বিচার কাজ শেষ হওয়ার কারণে অনেকেরই সাজা হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় গ্রেপ্তার এড়াতে বেশিরভাগ নেতাকর্মীই পলাতক। তাই আদালতে হাজিরা না দেয়ার বিষয়টি এমনিতেই হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বেশির ভাগ পলিটিক্যাল নেতা তো এমনিই পলাতক। হাজিরা দেয়ার সুযোগ তাদের নেই। আর যাদের পদ-পদবি আছে, তারা কেউই কোর্টে হাজিরা দিচ্ছেন না।সূত্র:ভোরেরকাগজ।