সাংবাদিক নাদিম হত্যার বিচারের সর্বশেষ সময় পর্যন্ত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সোচ্চার থাকবে

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে স্বামী হত্যার সুবিচারের আকুতি জানান, প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বাংলারচিঠিডটকম : বহুল আলোচিত জামালপুরের বকশীগঞ্জের সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ২০ জুন দুপুরে জামালপুরের বকশীগঞ্জের নিলাক্ষীয়া ইউনিয়নের গুমেরপাড়া গ্রামে সাংবাদিক নাদিমের শোকার্ত পরিবারের স্বজনদের সাথে সাক্ষাত এবং সাংবাদিক নাদিমের কবর জিয়ারত করেছেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ২০ জুন বেলা ১২টার দিকে বকশীগঞ্জের নিলাক্ষীয়া ইউনিয়নের গুমেরপাড়ায় প্রয়াত সাংবাদিক নাদিমের বাড়িতে যান। সেখানে তিনি সাংবাদিক নাদিমের বাবা আব্দুল করিম, স্ত্রী মনিরা বেগম ও তিন সন্তানের সাথে দেখা করে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং গভীর সমবেদনা জানান। পরিবারের স্বজনদের বিভিন্ন অভিযোগ, দাবি-দাওয়ার কথা শুনেন। এ সময় তিনি সাংবাদিক নাদিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন এবং বিচারের সর্বশেষ সময় পর্যন্ত সোচ্চার থাকবেন বলে সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী-সন্তানদের আশ্বাস দিয়েছেন। একই সাথে তিনি নিজেও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। সাংবাদিক নাদিমের বাড়িতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের উপস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক উৎসুক মানুষ ভিড় করেন।

পরে তিনি সাংবাদিক নাদিম হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা জানি পুরা ঘটনাটা যেটা সেদিন রাতে ঘটেছিল। সেখানে ওই চেয়াম্যানের ছেলে রিফাত কিভাবে ইট দিয়ে আঘাত করেছিল মাথার ওপরে, সে কথাগুলো আমরা জানি। হত্যাকারীদের মধ্যে সে হলো অন্যতম আমি বিশ্বাস করি। সে পালিয়ে আছে। আমার বিশ্বাস সে পালিয়ে থাকতে পারবে না।

বকশীগঞ্জের নিলাক্ষীয়া ইউনিয়নের গুমেরপাড়া গ্রামে প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমের কবর জিয়ারত করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। ছবি: বাংলারচিঠিডটকম

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে এই পরিবারের পাশে আছে, সেটার প্রমাণ ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে। বাকি আসামি যারা আছে আমি বিশ্বাস করি তারা ধরা পড়বেই। এখানে এ ব্যাপারে কোন রকমের ত্রুটি হবে না। আপনাদের এখানে জামালপুরের এসপি সাহেব আছেন, জেলা প্রশাসকের কর্মকর্তা আছেন। আমরা জানি যে, সবাই মিলে প্রচেষ্টা নিচ্ছে। যারা হত্যাকারী আর যারা হত্যার সহায়তাকারী তারা ধরা পড়বেই। আমি এটা নিজেও দাবি করি যে, তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। সেই অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া যেটা, সেটা সঠিকভাবে পরিচালিত হবে এবং এর মাধ্যমে যে অন্যায় তারা করেছে সেটার একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমিও দাবি করি এটা।

তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি যে, জনাব গোলাম রাব্বানী নাদিমকে হত্যা করার মাধ্যমে যে অন্যায়টা করা হয়েছে, এর মাধ্যমে যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে তার ফলে পরবর্তীতে যে কোনো সাংবাদিকের গায়ে হাত তোলার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যারা সত্য সংবাদ প্রচার করছে, যারা জনমানুষের অধিকার তুলে ধরছে, যারা অধিকারকর্মী, সেই সাংবাদিকদের যারা অন্যায় করে আক্রমণ করবে তাদের অন্ততপক্ষে ১০ বার ভাবতে হবে। প্রভাবশালীদের চিন্তা করতে হবে যে, আক্রমণ করে রেহাই পাওয়া যায় না। তাই তারা আর এরকম করবে না। সারা দেশব্যাপী এই সংস্কৃতি হবে, এই প্রত্যাশা রাখি।

ড. কামাল উদ্দিন নাদিম হত্যা মামলা এজাহারভুক্ত সকল আসামি ধরা পড়বে উল্লেখ করে বলেন, এই মামলার এজাহারভুক্ত যারা আছে অবশ্যই তাদেরকে ধরা হবে নিশ্চিত। এখানে এসপি সাহেব নিজেও বলেছেন সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। মূল আসামির ভেতর বেশ কয়জনই ধরা পড়েছে। মূলই যে সেই ধরা পড়েছে, সে আপনারা জানেন। সুতরাং চেয়ারম্যান তো ধরা পড়েছেই সেটা সবচে বড় কথা। মূলই ধরা পড়েছে। ধরপাকড় চলমান থাকবে।

সাগর-রুনিসহ এ যাবতকালে যত সাংবাদিক হত্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সেটার সমীকরণে কারোরই ওইভাবে বিচার হয়নি, সেই সমীকরণে নাদিম হত্যার সঠিক বিচার পাবে কিনা, আর এ ব্যাপারে শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কি ধরনের ভূমিকা নিবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, হ্যাঁ, এগুলো সম্পর্কে আমরা অবহিত আছি। বিশেষ করে সাগর-রুনির ব্যাপারটি আমি খুব ভালো করেই জানি। প্রায় ১০০ বারের প্রচেষ্টা নিয়েও এখন পর্যন্ত তদন্ত রিপোর্ট দিতে না পারলেও সময় চাওয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে, রিপোর্ট আসবে এবং বিচার হবে। আর এখানে অন্যান্য যেগুলো হয়েছে, যেখানে যাকে ধরতে পেরেছে তাদের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। বিচার চলছে, বা বিচারের আওতায় এসেছে। শেষ পর্যন্ত শাস্তি হবে।

তিনি বলেন, তবে আমার মনে হয় এই ঘটনার (নাদিম হত্যা) ক্ষেত্রে হত্যাকারী বা যারা অন্যায়কারী তাদেরকে ধরপাকড় করার ক্ষেত্রে সফলতার পরিমাণ অনেক বেশি। অনেক কিছুই কিন্তু সুস্পষ্ট। সেই সিসিটিভি থেকে শুরু করে পরবর্তী ঘটনাগুলো এবং বিভিন্ন বক্তব্যগুলো সেগুলো কিন্তু সুস্পষ্ট। সেগুলো ইতিবাচক। সেই ইতিবাচকতার ধারাবাহিকতায় আমি বিশ্বাস করি যে এখানে বিলম্ব হওয়ার মতো বা অস্বস্তিতে থাকার মতো অবস্থা বোধহয় নেই। এক্ষেত্রে আমি সরকারের সাথে কথা বলেছি। আইনমন্ত্রী মহোদয়ের সাথেও স্পষ্টভাবে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন যে, এটার অবশ্যই বিচার হবে। এটির বিচারের জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবেও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলাম। সোচ্চার থাকবো। বিচারের সর্বশেষ পর্যন্ত আমরা সোচ্চার থাকবো।

এর আগে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সাংবাদিক নাদিমের জিডি যে ওসি গ্রহণ করেননি, নাদিম হত্যা মামলার তদন্তে সেই ওসির ওপর কতটুকু ভরসা করা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নাদিম হত্যা মামলাটির তদন্ত ইতিমধ্যে ডিবিপুলিশের কাছে চলে গেছে। আগের ঘটনা নিয়ে মনে কষ্ট পাওয়ার কোনো কারণ নেই। সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। সেটা কোন অবস্থায় কি পরিস্থিতে কে কি বলেছিলেন। সেটা হয়তো সময়ই ব্যাখ্যা করবে। ডিবির কার্যক্রম আরো পুঙ্খানুপুঙ্খু। আরো সুস্পষ্ট, আরো গভীর। নিশ্চিত থাকেন, এই মামলার তদন্ত আরো এগিয়ে যাবে।

পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিক নাদিমের কবর জিয়ারত করেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন। এ সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) মো. আশরাফুল আলম, পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) আরফান আশিক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মুক্তার হোসেন ও পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

এরপর তিনি বিকেল ৩টায় জেলা প্রশাসন আয়োজিত জেলা মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ ও সুরক্ষা কমিটির সদস্য স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে মতবিনিময় করেন।

এদিকে নিজ বাড়িতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের আগমনের এক প্রতিক্রিয়ায় প্রয়াত সাংবাদিক নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম বাংলারচিঠিডটকমকে বলেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান স্যারের কাছে আমার প্রথম দাবি ছিল, আমার স্বামী হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। যাতে হত্যার সাথে জড়িত সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে আইনি কার্যক্রম শেষ করে আমার স্বামী হত্যার যেন বিচার করা হয়। তাদেরকে যেন ফাঁসি দেওয়া হয়। বাকি যে আসামিগুলো আছে তাদেরকে যেন দ্রুত গ্রেপ্তার করা হয়। প্রধান আসামির ছেলে রিফাত এখনো বাইরে আছে। আমরা আতঙ্কে আছি। আমাকে বা আমার পরিবারের কাউকে হত্যাও করতে পারে। উনার বাবার বিরুদ্ধে এক নিউজের জন্য আমার স্বামীর প্রাণ গেছে। উনার বাবা জেলে, একারণে হয়তো এমনও হতে পারে যে, আমাদের আরো ক্ষতি করতে পারে। বাকি নামধারী আসামিগুলো যেন দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করা হয় সেই দাবিই জানিয়েছি। তাকে আরো বলছি যে, আমি একজন সাংবাদিকের স্ত্রী। আমার স্বামী সত্য নিউজ করার জন্য বারবার নির্যাতিত হয়েছেন। তিনি কোনো দিন অন্যায়ের সাথে আপস করেন নাই। এই বিচারের মাধ্যমে যাতে বাংলাদেশে বা সারা পৃথিবীতে আর কোনো সাংবাদিক যাতে নির্যাতিত না হয় এই বিচারের মাধ্যমে সেটাই দেখানোর দাবি জানিয়েছি।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের আশ্বাসের কথা উল্লেখ করে মনিরা বেগম বলেন, উনি বলছেন যে, ‘আমি এই কাজটা দ্রুত সম্পন্ন করবো। আমরা সোচ্চার আছি। এরমধ্যে কোনো ফাঁকফোকর থাকবে না।’