পরিবেশ থিয়েটার : আশেক মাহমুদ কলেজ ডিগ্রি হোস্টেল বধ্যভূমি নাটক মঞ্চায়িত
মোস্তফা মনজু, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বাংলারচিঠিডটকম: সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেল বধ্যভূমিতে মঞ্চস্ত হয়েছে পরিবেশ থিয়েটারের নাটক ‘গণহত্যা : আশেক মাহমুদ কলেজ ডিগ্রি হোস্টেল বধ্যভূমি’। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে মঞ্চায়িত এই নাটকটি জামালপুর শহরবাসীর মাঝে বেশ সাড়া ফেলে।
কাহিনি সংক্ষেপ : তৎকালীন জামালপুর মহকুমা শহরে আশেক মাহমুদ কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৬ সালে। ১৯৭৯ সালে জাতীয়করণ হয়ে এর নাম হয় সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ। ১৯৫১ সালে এই কলেজে ডিগ্রি কোর্স চালু হওয়ার পর স্থাপিত হয় ডিগ্রি হোস্টেল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জামালপুর মহকুমা শহরের এই ডিগ্রি হোস্টেলটি ছিল আন্দোলন ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম জামালপুর থেকেই আলবদর বাহিনী গঠন ও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী আশরাফ হোসেন আলবদর বাহিনীর জামালপুর মহকুমা কমান্ডার ছিলেন। তার মাধ্যমেই মূলত: ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনী গঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেলটি দখল করে স্থাপন করা হয় আলবদর বাহিনীর প্রধান টর্সার সেল। এই টর্চার সেলে মূলত: মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের তরুণ-যুবক ছেলেদের এবং মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ নিরীহ পরিবারের পুরুষ ও নারীদের ধরে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। অনেক মানুষকে তারা এখানে জবাই করে, নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে শেয়ালকুকুরের আহার হিসেবে নিকটবর্তী ফৌতিগোরস্থান এলাকায় ফেলে রাখা হতো। আশেক মাহমুদ কলেজের আশপাশের এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নারী-পুরুষদের ধরে এনে এই হোস্টেলে আটক রেখে বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আলবদর, রাজাকার বাহিনীর নৃশংস এই জল্লাদখানা আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেলের এই বধ্যভূমি। স্বাধীনতার পর এই বধ্যভূমিতে একটি বেদী নির্মাণ করা হয়। খুব শিগিগির এই হোস্টেলটির আগের আদল ঠিক রেখে সংস্কার, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর ও একটি আধুনিক স্থাপত্যনির্ভর বেদী নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
মুজিব জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশব্যাপী পরিবেশ থিয়েটারের মাধ্যমে নাটক মঞ্চায়ন করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামালপুরে আলবদর বাহিনীর বিভৎস টর্চার সেল খ্যাত আশেক মাহমুদ কলেজের পরিত্যক্ত ডিগ্রি হোস্টেলের বধ্যভূমি প্রাঙ্গণে ৩০ ডিসেম্বর মঞ্চায়িত হয় পরিবেশ থিয়েটারের নাটক ‘গণহত্যা : আশেক মাহমুদ কলেজ ডিগ্রি হোস্টেল’।
জেলা প্রশাসন ও সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় নাটকটি মঞ্চয়ান করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি। জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগসহ জেলার বিভিন্ন নাট্য সংগঠনের সংগঠক, নাট্যকর্মী মিলে শতাধিক কলাকুশলী এ নাটকে অংশ নেন। নাটকটি শুরু হয় রাত সাড়ে ৮টায়। নাট্যকার শাহীন রহমানের রচনায় ও অধ্যাপক ফাহিম মালিক ইভানের নির্দেশনায় ৬৫ মিনিটের নাটকটি দেখতে খোলা আকাশের নিচে পৌষের কনকনে শীত উপেক্ষা করে নারী-পুরুষ-শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের অন্তত পাঁচ সহস্রাধিক দর্শক উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আল বদর বাহিনীর কমান্ডার আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে নৃশংস নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয় এই নাটকে।
নাটক শেষে মুক্তিযুদ্ধকালীন ডিগ্রি হোস্টেলের বিভিন্ন কক্ষে গণহত্যায় নিহতদের করুণ মৃত্যু ও নির্যাতনের কিছু বিভৎস অবয়ব অতিথি ও দর্শনার্থীদের দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। এসব বিভৎস দৃশ্য দেখে এ সময় আবেগ আপ্লুত হয়ে অনেকের চোখেই পানি এসে যায়।
ডিগ্রি হোস্টেল বধ্যভূমি প্রাঙ্গণে খোলা আকাশের নিচে মঞ্চায়িত এই নাটক শুরু হওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এমপি। জেলা প্রশাসক মুর্শেদা জামানের সভাপতিত্বে এ সময় ডিগ্রি হোস্টেলে আলবদর বাহিনীর টর্চার সেলে গণহত্যার বিভৎস ঘটনার কথা উল্লেখ করে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জামালপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোজাফফর হোসেন, সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সফিকুল ইসলাম, সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মুজাহিদ বিল্লাহ ফারুকী, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক আহাম্মেদ চৌধুরী, পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন আহমেদ, প্রবীণ সাংবাদিক উৎপল কান্তি ধর, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ আতিকুর রহমান ছানা প্রমুখ।