২০২৪ সালের আগস্ট, রবিবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মো. ইমরান (২২)। এরপর দীর্ঘদিন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে বাড়ি ফিরলেও সম্পূর্ণ স্মৃতি ফিরে পাননি তিনি। এখনও শুকায়নি ইমরানের মাথায় গুলির ক্ষতচিহ্ন। তার চিকিৎসার খরচ জোগাতে পরিবারের আয়ের একমাত্র সম্বল অটোরিকশা বিক্রি করে দেন রিকশাচালক বাবা বিল্লাল। ইমরানের বাবার রিকশার চাকা ঘোরানো পরিশ্রমের টাকায় চলত ছোট ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের যাবতীয় ব্যয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে ইমরানের পরিবারের।
মো. ইমরানের বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার বালিজুড়ী ইউনিয়নের তারতাপাড়া গ্রামে। মেধাবী শিক্ষার্থী ইমরান এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ইমরানের পরিবারে মা-বাবা, দুই ভাই-বোন ও বৃদ্ধা দাদী রয়েছে। ইমরান তার ভাই-বোনদের মধ্যে বড়। তার বাবা বিল্লাল পেশায় রিকশাচালক। ইমরানদের বসতঘরের জায়গা ছাড়া চাষযোগ্য কোন জমি নেই। অভাব অনটনে পড়ে সংসারের প্রয়োজনে তিনি স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্ডেনে শিক্ষকতা শুরু করেন।
এরপর পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন ইতালিতে। এজন্য স্থানীয় এক আদমব্যবসায়ীর কাছে টাকা ও পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। ইতালি যেতে আরও বেশ কয়েকমাস সময় লাগবে বিধায় জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরুতে তিনি আশুলিয়ার বাইপাইল একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি নেন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন।
জানা গেছে, গত বছর ৪ আগস্ট বিকালে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সাথে ছাত্র-জনতার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সে সময় পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ে। এতে ইমরান মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
আন্দোলনকারীরা ইমরানকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলেও তাকে চিকৎসা দেওয়া হয়নি। পরে ইমরানকে আশুলিয়া মা ও শিশু হাসপাতালে নেওয়া হয়। ইমরানের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপালে নেয়া হয়। চিকিৎসকেরা সাড়ে ৪ ঘন্টা চেষ্টার পর ইমরানের মাথা থেকে গুলি বের করতে সক্ষম হয়। ইমরানের শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ২৫ দিন পর সিএমএইচ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তিন মাস চিকিৎসা নেয়ার পর কিছুটা সুস্থ হলে বাড়িতে ফিরেন।
অটোরিকশা বিক্রির টাকা এবং অন্যদের সহায়তায় চিকিৎসা শেষে ইমরান বাড়িতে ফিরলেও বাবার আয়ের শেষ সম্বল রিকশাটি বিক্রি করে এখন অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি। উচ্চ মূল্যের বাজারে সংসারের খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে বিল্লালের। ধারদেনা ও অন্যের সাহায্য নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।
ইমরানের বাবা বিল্লাল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পরিবারের আয়ের উৎস ছিল আমার রিকশা আর ছেলের সামান্য আয়। ছেলের চিকিৎসার জন্য রিকশাটি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন পরিবার নিয়ে চলতে পারছি না। স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। ইমরানকে চিকিৎসা করাতে প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এরমধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে চার লাখ, ডিজিএফআই কর্মকর্তা দিয়েছেন ১০ হাজার টাকা, জেলা প্রশাসক কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, জামায়াতের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, স্থানীয় সমাজসেবা অফিস থেকে তিন হাজার টাকাসহ মোট চার লাখ ৩৩ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা পেয়েছি।
আমি সরকারের কাছে ছেলের সুচিকিৎসার দাবি জানাই। আমার ছেলে সুস্থ হলে সবই হবে। আমাদের দুঃখকষ্ট কিছুই থাকবে না। সরকারের কাছে আবেদন যারা আমার ছেলেকে গুলি করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এঘটনায় ইমরানের বাবা বিল্লাল বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় সাবেক সংসদ সদস্য বেনজির আহমেদকে প্রধান আসামি করে করে ১১ জন এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত ৩০০-৪০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন।