ঢাকা ০৯:৫৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
জামালপুরে ইয়াবাসহ এক নারী গ্রেপ্তার “বাংলাদেশের মানুষ সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচন চায়” জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিন শহীদের স্মরণে সরিষাবাড়ীতে বৃক্ষরোপণ জামালপুরে পল্লীকন্ঠ পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জুলাইয়ের শহীদের স্মরণে ইসলামপুরে ছাত্রদলের দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত শেরপুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জামালপুরে জুলাই গণঅভ্যুত্থান শহীদদের স্মরণে ‘এক শহীদ, এক বৃক্ষ’ কর্মসূচি জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস : জামালপুরে ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত নান্দিনায় ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত জুলাই শহীদদের স্মরণে জামালপুরে বিএনপির শোক মিছিল অনুষ্ঠিত

সুফল-২ প্রকল্পের আগাম সতর্ক বার্তা বন্যার হাত থেকে জানমাল রক্ষা করছে

জামালাপুর : সুফল-২ প্রকল্পের আওতাধীন বন্যার আগাম বার্তা মাদারগঞ্জের বানবাসী মানুষের জীবন চলাচল সহজ করে দিয়েছে। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

“মোবাইলে খবর পাইয়ে বানে আমাগো কম ক্ষতি করছে। গেল বার বানের পানিতে খেতের ধান পাট খায়ে গেলেও ঘরের কুনো জিনিস নস্ট অয় নাই। পোলাপান নিয়ে বান্দে উঠছিলাম। হগলেরই উপকার অইছে। গাঙ্গে আমাগোর সবকিছু ভাইঙ্গে নিছে। তয় বানের পনিতে ভাসাই নিতে পারে নাই। মাদারগঞ্জ উপজেলার চরপাকেরদহ ইউনিয়নের যমুনা পাড়ের পাকরুল গ্রামের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ সুলতান সরকার আবেগের সাথে কথাগুলো বলেন।

জামালপুর জেলার অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ উপজেলা মাদারগঞ্জ। এরমধ্যে অতিমাত্রায় নদীভাঙ্গন আর বন্যায় প্রতিবছরই আক্রান্ত হয়ে থাকে উপজেলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদাপন্ন ইউনিয়ন চরপাকেরদহ। বিশেষ করে যমুনানদী পাড়ের গ্রাম হিদাগাড়ি, পাকরুলের বাসিন্দারা। ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় এক হাজার দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস। এ এলাকার বাসিন্দারা দুর্যোগের সাথে লড়াই করে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে।

প্রত্যন্ত এ চরাঞ্চলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং সম্পদের অসম বন্টন ও বৈষম্য ভাগ্যবঞ্চিত মানুষগুলো নিয়তি হিসেবেই মেনে নেয়। তবে কেয়ার বাংলাদেশের বাস্তবায়নাধীন সুফল-২ প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যার আগাম সতর্ক বার্তা জানমালের ক্ষতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখছে বলে সুলতান সরকারের মত একাধিক এলাকাবাসীর অভিমত।

সংরক্ষিত মহিলা আসনের ইউপি সদস্য রিমা খাতুন বলেন, বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে প্রতি বছর অসংখ্য পরিবার সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। গত বছর শতাধিক পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। তবে বন্যার আগাম বার্তা পাওয়ায় মধ্যমপর্যায়ের বন্যায় ফসলহানি হলেও ক্ষতির মাত্রা কম হইছে। ২০২০ ও ২০২১ সালের বন্যার সময়েও মোবাইল ফোনে বন্যার প্রতিনিয়ত আগাম খবর পেয়ে মানুষের অনেক উপকার হইছে। তিনি সুফল-২ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ইউপি সদস্য রিমার মত বন্যার সাথে যুদ্ধ করা অসংখ্য উপকারভোগী মানুষের কণ্ঠে একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়। বেখেয়ালি যমুনার তীব্র আঘাতের পাশাপাশি ১৯৮৮ সাল থেকে শ্বেত দানব অর্থাৎ প্রবল বন্যার ফলে প্রতিবছরই মানুষের স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণা সহ্য করে আসছে হিদাগাড়ি ও পাকরুলের হতভাগ্য মানুষগুলো। অতিবন্যার প্রচন্ড স্রোতে ফসলি জমি, গাছপালাসহ প্রাণিসম্পদ ভাসিয়ে নিত। এতে করে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আসছিল। ২০১৯ সাল থেকে কেয়ার বাংলাদেশের সুফল-২ প্রকল্প এ এলাকায় কাজ শুরু করার পর আগ্রাসী বন্যার হাত থেকে মানুষ অনেক উপকার পাচ্ছে বলে মাদারগঞ্জবাসী জানায়।

জামালাপুর : সুফল-২ প্রকল্পের আওতাধীন বন্যার আগাম বার্তা মাদারগঞ্জের বানবাসী মানুষের জীবন চলাচল সহজ করে দিয়েছে। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

গত বছর বন্যা হলেও এলাকাবাসীর মধ্যে তেমন একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নাই। এ ব্যাপারে স্কুল শিক্ষক মাহবুব আলম বলেন, কেয়ার বাংলাদেশসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, ওরিয়েন্টেশন দেয়ার ফলে মানুষ অনেক সচেতন ছিল। বিশেষ করে সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে বীজতলা তৈরি, মৎস্যসম্পদ রক্ষা, প্রাণিসম্পদের সুরক্ষা, বন্যার পূর্বে ও বন্যাকালিন করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে মানুষ খুবই উপকার পেয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পের মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদী হলে পাল্টে যাবে মানুষের জীবনধারা।

পঞ্চাশোর্ধ আবদালী বলেন, বানের পাঁচ বছর ধইরে বানের আগাও খবর হুইনে আগেবাগে হগলকিছু মিছিল কইরে রাহি। এর লাইগে আমাগো খতি কম অয়। আমাগো শক্ত কইরা এডা বাধ বাইন্দে দিলে নদীও ভাঙতো না আর বানের সুময় বান্দে গরু, ছাগল নিয়ে উটতে পাইতাম।

আবদালির মত অসংখ্য মানুষের প্রাণের দাবি বাঁধ নির্মাণের পাশপাশি নদী খনন করা হোক। নদীতে উজানের পলি এসে তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় অতিবন্যার সময় যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে সমতলে পানি উঠে ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যপক ক্ষতি সাধন হয়। সরকার আসে সরকার যায় চরপাকেরদহ ইউনিয়নবাসীর দাবি আর পূরণ হয় না। ইউপি সদস্য আহাজ ফকির আক্ষেপের সাথে বলেন, নির্বাচনী মৌসুমে বসন্তের কোকিলের মত প্রার্থীরা উন্নয়নের গান শোনায়। নির্বাচনে জিতে তারা সেই যে উড়ে যায় আর ফিরেও তাকায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে বড় তিনটি দল ক্ষমতায় এসেছে। তারা নিজেদের আখের গোছালেও আমাদের দুঃখ গোছাতে পারে নাই। আমরা বাঁধ নির্মাণ ও নদী খননের জন্য বার বার আকুতি জানিয়ে আসছি। আমাদের এ আকুল আবেদন শুধু শুন্য আকাশে ভেসে বেড়ায়। আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য জোর আবেদন করছি।

মাদারগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাদির শাহ বলেন, আমরা বন্যা মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি সবসময় রাখি। গত কয়েক বছরে বড় ধরনের বন্যা আসে নাই। তিনি সুফল-২ প্রকল্পের প্রশংসা করে বলেন, এ ধরনের প্রকল্প থেকে এলাকাবাসী অবশ্যই উপকৃত হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী হওয়া উচিৎ। সরকারিভাবে বন্যার আগাম বার্তা বিভিন্ন মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে তিনি সুফল-২ প্রকল্পের ধারণা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে শেয়ার করবেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্যায় এবং নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলোর জন্য আমরা স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করছি। আপদকালীন গৃহহারা মানুষগুলো বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে পারে। এ ব্যপারে আমরা সব ধরনের সহায়তা করা হবে।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, নদী খনন কাজ আমরা শুরু করেছি আনেক আগে থেকেই। তবে এখন বিশেষ কারণে বন্ধ থাকলেও আবার শুরু হবে। তিনি বন্যা সতর্ক বার্তা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার আগে ও বন্যাকালিন প্রতিনিয়তই ম্যাসেজ প্রচার করে থাকি বিভিন্ন মাধ্যমে। তিনি সুফল-২ প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পর্কে জেনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ প্রকল্পের ধারণা সরকার কাজে লাগাতে পারে। তিনি বলেন, ভাঙ্গন ঠেকাতে আমরা ১৮৫ মিটার স্থান জুড়ে জিও ব্যগ ফেলছি। এর ফলে বন্যা আসলে ভাঙ্গনের তীব্রতা যেমন কমবে তেমনি দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি রক্ষায় কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে।

চার বছর পর ২০২৪ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও মাদারগঞ্জ উপজেলায় মধ্যম পর্যায়ের বন্যা আসে। যমুনা নদী বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্যপক ফসলহানি ঘটে। তবে কেয়ার বাংলাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়িত সুফল প্রকল্পের আগাম সতর্ক বার্তা ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ভূমিকা পালন করে। মানুষ ও গবাদি প্রাণিসহ অন্যান্য সম্পদ স্থানান্তর কর সম্ভব হয়।

এ সময়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ পাঁচ শতাধিক পরিবারের মাঝে খাদ্য, আর্থিক ও হাইজেনিক কীট সহায়তা দেওয়া হয়। সুফল-২ প্রকল্পের আওতায় আগাম বার্তা প্রদানের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক টনি মাইকেল বলেন, সুফল-২ প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকিতে মানুষগুলোকে আমরা আগাম বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তাদের গবাদি প্রাণি, মৎস্য সম্পদ, বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পুনর্বাসনে কারিগরী জ্ঞান দানের পাশাপাশি কিছু আর্থিক সহায়তাও দিয়ে থাকি। আমরা মূলত এটা পাইলটিং প্রকল্প হিসেবে নিয়েছি। সরকার যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষ উপকৃত হবে।

তিনি আরও বলেন, স্কেলিং আপ ফ্লাড ফোরকাস্ট বেইজ অ্যাকশন এন্ড লার্নিং ইন বাংলাদেশ বা সুপল-২ প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ ২০১৯-২০২১ মেয়াদে প্রকল্পে সাফল্যের ভিত্তিতে ২০২১ সাল থেকে শুরু হয় সুফল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়। চলবে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত। তিনি প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটির এবং এবং সাংবাদিকদের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

জনপ্রিয় সংবাদ

জামালপুরে ইয়াবাসহ এক নারী গ্রেপ্তার

সুফল-২ প্রকল্পের আগাম সতর্ক বার্তা বন্যার হাত থেকে জানমাল রক্ষা করছে

আপডেট সময় ১১:৪৮:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

“মোবাইলে খবর পাইয়ে বানে আমাগো কম ক্ষতি করছে। গেল বার বানের পানিতে খেতের ধান পাট খায়ে গেলেও ঘরের কুনো জিনিস নস্ট অয় নাই। পোলাপান নিয়ে বান্দে উঠছিলাম। হগলেরই উপকার অইছে। গাঙ্গে আমাগোর সবকিছু ভাইঙ্গে নিছে। তয় বানের পনিতে ভাসাই নিতে পারে নাই। মাদারগঞ্জ উপজেলার চরপাকেরদহ ইউনিয়নের যমুনা পাড়ের পাকরুল গ্রামের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ সুলতান সরকার আবেগের সাথে কথাগুলো বলেন।

জামালপুর জেলার অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ উপজেলা মাদারগঞ্জ। এরমধ্যে অতিমাত্রায় নদীভাঙ্গন আর বন্যায় প্রতিবছরই আক্রান্ত হয়ে থাকে উপজেলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদাপন্ন ইউনিয়ন চরপাকেরদহ। বিশেষ করে যমুনানদী পাড়ের গ্রাম হিদাগাড়ি, পাকরুলের বাসিন্দারা। ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় এক হাজার দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস। এ এলাকার বাসিন্দারা দুর্যোগের সাথে লড়াই করে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে।

প্রত্যন্ত এ চরাঞ্চলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং সম্পদের অসম বন্টন ও বৈষম্য ভাগ্যবঞ্চিত মানুষগুলো নিয়তি হিসেবেই মেনে নেয়। তবে কেয়ার বাংলাদেশের বাস্তবায়নাধীন সুফল-২ প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যার আগাম সতর্ক বার্তা জানমালের ক্ষতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখছে বলে সুলতান সরকারের মত একাধিক এলাকাবাসীর অভিমত।

সংরক্ষিত মহিলা আসনের ইউপি সদস্য রিমা খাতুন বলেন, বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে প্রতি বছর অসংখ্য পরিবার সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। গত বছর শতাধিক পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। তবে বন্যার আগাম বার্তা পাওয়ায় মধ্যমপর্যায়ের বন্যায় ফসলহানি হলেও ক্ষতির মাত্রা কম হইছে। ২০২০ ও ২০২১ সালের বন্যার সময়েও মোবাইল ফোনে বন্যার প্রতিনিয়ত আগাম খবর পেয়ে মানুষের অনেক উপকার হইছে। তিনি সুফল-২ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ইউপি সদস্য রিমার মত বন্যার সাথে যুদ্ধ করা অসংখ্য উপকারভোগী মানুষের কণ্ঠে একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়। বেখেয়ালি যমুনার তীব্র আঘাতের পাশাপাশি ১৯৮৮ সাল থেকে শ্বেত দানব অর্থাৎ প্রবল বন্যার ফলে প্রতিবছরই মানুষের স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণা সহ্য করে আসছে হিদাগাড়ি ও পাকরুলের হতভাগ্য মানুষগুলো। অতিবন্যার প্রচন্ড স্রোতে ফসলি জমি, গাছপালাসহ প্রাণিসম্পদ ভাসিয়ে নিত। এতে করে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আসছিল। ২০১৯ সাল থেকে কেয়ার বাংলাদেশের সুফল-২ প্রকল্প এ এলাকায় কাজ শুরু করার পর আগ্রাসী বন্যার হাত থেকে মানুষ অনেক উপকার পাচ্ছে বলে মাদারগঞ্জবাসী জানায়।

জামালাপুর : সুফল-২ প্রকল্পের আওতাধীন বন্যার আগাম বার্তা মাদারগঞ্জের বানবাসী মানুষের জীবন চলাচল সহজ করে দিয়েছে। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

গত বছর বন্যা হলেও এলাকাবাসীর মধ্যে তেমন একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নাই। এ ব্যাপারে স্কুল শিক্ষক মাহবুব আলম বলেন, কেয়ার বাংলাদেশসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, ওরিয়েন্টেশন দেয়ার ফলে মানুষ অনেক সচেতন ছিল। বিশেষ করে সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে বীজতলা তৈরি, মৎস্যসম্পদ রক্ষা, প্রাণিসম্পদের সুরক্ষা, বন্যার পূর্বে ও বন্যাকালিন করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে মানুষ খুবই উপকার পেয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পের মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদী হলে পাল্টে যাবে মানুষের জীবনধারা।

পঞ্চাশোর্ধ আবদালী বলেন, বানের পাঁচ বছর ধইরে বানের আগাও খবর হুইনে আগেবাগে হগলকিছু মিছিল কইরে রাহি। এর লাইগে আমাগো খতি কম অয়। আমাগো শক্ত কইরা এডা বাধ বাইন্দে দিলে নদীও ভাঙতো না আর বানের সুময় বান্দে গরু, ছাগল নিয়ে উটতে পাইতাম।

আবদালির মত অসংখ্য মানুষের প্রাণের দাবি বাঁধ নির্মাণের পাশপাশি নদী খনন করা হোক। নদীতে উজানের পলি এসে তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় অতিবন্যার সময় যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে সমতলে পানি উঠে ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যপক ক্ষতি সাধন হয়। সরকার আসে সরকার যায় চরপাকেরদহ ইউনিয়নবাসীর দাবি আর পূরণ হয় না। ইউপি সদস্য আহাজ ফকির আক্ষেপের সাথে বলেন, নির্বাচনী মৌসুমে বসন্তের কোকিলের মত প্রার্থীরা উন্নয়নের গান শোনায়। নির্বাচনে জিতে তারা সেই যে উড়ে যায় আর ফিরেও তাকায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে বড় তিনটি দল ক্ষমতায় এসেছে। তারা নিজেদের আখের গোছালেও আমাদের দুঃখ গোছাতে পারে নাই। আমরা বাঁধ নির্মাণ ও নদী খননের জন্য বার বার আকুতি জানিয়ে আসছি। আমাদের এ আকুল আবেদন শুধু শুন্য আকাশে ভেসে বেড়ায়। আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য জোর আবেদন করছি।

মাদারগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাদির শাহ বলেন, আমরা বন্যা মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি সবসময় রাখি। গত কয়েক বছরে বড় ধরনের বন্যা আসে নাই। তিনি সুফল-২ প্রকল্পের প্রশংসা করে বলেন, এ ধরনের প্রকল্প থেকে এলাকাবাসী অবশ্যই উপকৃত হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী হওয়া উচিৎ। সরকারিভাবে বন্যার আগাম বার্তা বিভিন্ন মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে তিনি সুফল-২ প্রকল্পের ধারণা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে শেয়ার করবেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্যায় এবং নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলোর জন্য আমরা স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করছি। আপদকালীন গৃহহারা মানুষগুলো বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে পারে। এ ব্যপারে আমরা সব ধরনের সহায়তা করা হবে।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, নদী খনন কাজ আমরা শুরু করেছি আনেক আগে থেকেই। তবে এখন বিশেষ কারণে বন্ধ থাকলেও আবার শুরু হবে। তিনি বন্যা সতর্ক বার্তা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার আগে ও বন্যাকালিন প্রতিনিয়তই ম্যাসেজ প্রচার করে থাকি বিভিন্ন মাধ্যমে। তিনি সুফল-২ প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পর্কে জেনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ প্রকল্পের ধারণা সরকার কাজে লাগাতে পারে। তিনি বলেন, ভাঙ্গন ঠেকাতে আমরা ১৮৫ মিটার স্থান জুড়ে জিও ব্যগ ফেলছি। এর ফলে বন্যা আসলে ভাঙ্গনের তীব্রতা যেমন কমবে তেমনি দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি রক্ষায় কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে।

চার বছর পর ২০২৪ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও মাদারগঞ্জ উপজেলায় মধ্যম পর্যায়ের বন্যা আসে। যমুনা নদী বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্যপক ফসলহানি ঘটে। তবে কেয়ার বাংলাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়িত সুফল প্রকল্পের আগাম সতর্ক বার্তা ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ভূমিকা পালন করে। মানুষ ও গবাদি প্রাণিসহ অন্যান্য সম্পদ স্থানান্তর কর সম্ভব হয়।

এ সময়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ পাঁচ শতাধিক পরিবারের মাঝে খাদ্য, আর্থিক ও হাইজেনিক কীট সহায়তা দেওয়া হয়। সুফল-২ প্রকল্পের আওতায় আগাম বার্তা প্রদানের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক টনি মাইকেল বলেন, সুফল-২ প্রকল্পের মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকিতে মানুষগুলোকে আমরা আগাম বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তাদের গবাদি প্রাণি, মৎস্য সম্পদ, বীজ সংরক্ষণ, কৃষি পুনর্বাসনে কারিগরী জ্ঞান দানের পাশাপাশি কিছু আর্থিক সহায়তাও দিয়ে থাকি। আমরা মূলত এটা পাইলটিং প্রকল্প হিসেবে নিয়েছি। সরকার যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষ উপকৃত হবে।

তিনি আরও বলেন, স্কেলিং আপ ফ্লাড ফোরকাস্ট বেইজ অ্যাকশন এন্ড লার্নিং ইন বাংলাদেশ বা সুপল-২ প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ ২০১৯-২০২১ মেয়াদে প্রকল্পে সাফল্যের ভিত্তিতে ২০২১ সাল থেকে শুরু হয় সুফল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়। চলবে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত। তিনি প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটির এবং এবং সাংবাদিকদের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।