চলছে বর্ষাকাল। বর্ষা মৌসুমে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় পানি উঠে এবং অনেক সময় বন্যার সৃষ্টি ফলে উঁচু এলাকাও তলিয়ে যায়। স্বাভাবিক কারণেই এই মৌসুমে নৌকা ব্যবহারের চাহিদা বেড়ে যায়। অনাগত বন্যা বা জলাবদ্ধতার সময় চলাচলের জন্য নতুন নৌকা তৈরি ও পুরাতন নৌকা মেরামতে ব্যস্ত হয়ে উঠেন শেরপুরের নকলা উপজেলার নিচু এলাকার জনগণ ও নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকার মাছ শিকারিরা।
বছরের আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্তÍ উপজেলার অনেক এলাকা পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যাকবলিত হয় এবং পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ফলে পথঘাটে পানি উঠে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জে যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে উঠে নৌকা। তাই এ সময় নৌকার কদর বেড়ে যায়। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে নতুন নৌকা তৈরি ও পুরাতন নৌকা মেরামতের ব্যাপক চাহিতা থাকায় নৌকা তৈরির কারিগরদের (কাঠমিস্ত্রি) ব্যস্ততা বেড়ে যায়। অনেক সময় স্থানীয় কারিগরদের রাত-দিন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে উপজেলার গণপদ্দী, নকলা, উরফা, বানেশ্বরদী, চরঅষ্টধর ও চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের নৌকা তৈরি ও মেরামতে কারিগরেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
স্থানীয় অনেকেই জানান, সাধারণত ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা ও বাইচের নৌকাই বেশি তৈরি করা হচ্ছে। বর্ষার কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কারিগরেরা দিনরাত কাজ করছেন। তবে অনেক কারিগর আছেন যারা সারা বছর অলস সময় কাটান। কিন্তু বর্ষার শুরুতে তাদের চাহিদাও বেড়ে গেছে।
বিভিন্ন এলাকার নৌকা তৈরির কারিগরেরা জানান, নিচু এলাকার জনগণ নতুন নৌকা তৈরির পাশাপাশি পুরাতন নৌকা মেরামতের জন্য তাদের কাছে ছুটে আসেন। এখন নৌকা তৈরি বা মেরামতের ভরা মৌসুম চলছে। তবে নৌকায় ব্যবহৃত সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। আগে নিচু এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি করে নৌকা থাকত। বৃষ্টি বাদল কম হওয়ায় নৌকার ব্যবহার আগের তুলনায় কমেছে। এছাড়া আগে নদ-নদী, খাল-বিলে প্রচুর বড় বড় মাছ ছিল। তখন মানুষ নদ-নদীতে নৌকা দিয়ে মাছ শিকারে যেতেন। এখন নদ-নদী ও খাল-বিলে মাছ কমে যাওয়ায় মাছ শিকারে নৌকার ব্যবহার অনেকটাই কমেছে বলে তারা জানান।
গণপদ্দী ইউনিয়নের বিহাড়িরপাড় এলাকার কাঠমিস্ত্রি আয়নাল হক বলেন, আমরা সারাবছর কাঠের বিভিন্ন কাজ করি। বর্ষার শুরুতে কিছু নৌকার কাজ আসে। এতে বাড়তি আয় হয়। তবে আগের তুলনায় নৌকার চাহিদা কমে গেছে।

উরফা ইউনিয়নের কুড়েরকান্দা এলাকার বদিউজ্জামান জানান, আগে বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতের জন্য এবং শখ করে নদ-নদীতে মাছ শিকারে ব্যবহারের জন্য তাদের বাড়িতে বেশ কয়েকটা নৌকা ছিল। এখন পানিও বেশি আসে না। তাছাড়া নদীতে আগের মত বড় বড় মাছও নেই। তাই এখন তাদের নৌকার ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে।
বানেশ্বরদী ইউনিয়নের ভ‚রদী এলাকার মাছ শিকারি মনসুর আলী বলেন, কোন একসময় আমাদের বাড়ির পাশের চায়রা বিলটি গভীরতা এবং পদ্ম ও সিংড়ার জন্য জেলাব্যাপি পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তনে এ বিলটি ভরাট হয়ে পানির গভীরতা কমে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী পদ্ম ও সিংড়া। বিলে ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে উঠেছে অগণিত মৎস্য খামার। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মাছ। তাই এখন আর নৌকা দিয়ে মাছ শিকারের পরিবেশ নেই। এসব কারণে আমাদের মত লোকের নৌকার ব্যবহার নেই বললেই চলে।
একই এলাকার মৎস্যজীবী আব্বাস আলী জানান, আগে চায়রা বিলে বড় বড় দেশি মাছ ধরতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসতেন। তারা স্থানীয়দের কাছে নৌকা ভাড়া নিতেন। আস্তে আস্তে বিলটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন দেশী মাছ কমে গেছে। তাই এখন আর বাহির থেকে কেউ মাছ শিকারে আসেন না। ফলে নৌকাও ভাড়া দেওয়া হয় না। স্বাভাবিক কারণেই এলাকার লোকজনের নৌকার ব্যবহার কমে গেছে।
চরঅষ্টধর ইউনিয়নের নারয়নখোলা এলাকার কাঠমিস্ত্রি আলমাছ আলী জানান, নৌকা তৈরিতে কড়ই, হিজল, মেহগনির কাঠ ও বাঁশ বেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আলকাতরা, তারকাটা ও গজলসহ বেশ কিছু উপকরণ প্রয়োজন হয়। গত বছর দুই বছর ধরে পাহাড়ি ঢলের কারণে নকলায় বন্যার সৃষ্টি হওয়ায় মানুষ আগের চেয়ে এ বছর ছোট নৌকা বেশি বানাচ্ছেন বলেও তিনি জানান। এ বছর তিনি ১৭-১৮টি নতুন নৌকা বানিয়েছেন এবং ৮-১০টি পুরাতন নৌকা মেরামত করেছেন। এসবের অধিকাংশ ছোট ডিঙি নৌক। যা স্থানীয় জেলেরা ও ছোট পরিবারের লোকজন পানিপথে যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করেন।
তিনি আরও জানান, আকার ভেদে ছোট ডিঙি নৌকা তৈরি বাবদ দুই হাজার ৫০০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা মজুরি নেয়া হয়। কাঠসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নৌকার মালিক কিনে দেন। এ বছর কাঠের গুণগত মান ও আকৃতি অনুযায়ী প্রতি নৌকা তৈরিতে সাত হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ পড়ছে। নৌকা তৈরির কাঠ, বাঁশ ও লোহাসহ অন্যান্য সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার নির্মান খরচ বেশি হচ্ছে। তবুও যাদের প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করছেন। তারা কেউই নৌকা বানানো বা মেরামতে থেমে নেই বলেও তিনি জানান।