‘জমিত শিমের ভালই ফলন হয়ছে, কিন্তু বাজারে দাম নেই। শিম চাষ করে লাভের মুখ দেখমু তো দূরের কথা খরচই তুলতে পারলাম না। জমি থেকে শিম তুলে হাট পর্যন্ত আনতে যে খরচ, সেই গাড়ি ভাড়াও ওঠে না। সব শিম গাছ কাইটা ফেলমু। একটা গাছও রাখমু না। আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন নিয়ে ধারদেনা করে শিম চাষ করেছিলাম। এখন তা পরিশোধ করমু কী করে সেই চিন্তায় আছি।’ কথাগুলো বলেন, জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার গুনারিতলা ইউনিয়নের বালাভরাট এলাকার শিম চাষী এমদাদ হোসেন।
শিম চাষী এমদাদ হোসেন জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ১৮ শতাংশ জমিতে শিম চাষ করেছিলেন। শিমের ভাল ফলনও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শিম আবাদ করে লাভ তো দূরের কথা, জমি থেকে শ্রমিক দিয়ে শিম তুলে হাটে নিতে যে খরচ, তাও ওঠেনি তার। ১৮ শতাংশ জমিতে শিষ চাষ করতে তার খরচ হয়েছে ২০-২২ হাজার টাকা। আশা ছিল ৫০-৬০ হাজার টাকার শিম বিক্রি করে লাভবান হবেন। কিন্তু তিনি মাত্র ৫০০ টাকারও শিম বিক্রি করতে পারেননি। সেই আক্ষেপে জমির সব শিম গাছ কেটে ফেলে দিয়েছেন তিনি।

তিনি আরও জানান, ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার দু’জন শ্রমিক নিয়ে তিন বস্তা শিম তুলে স্থানীয় বাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শিম তুলতে দু’জন শ্রমিকের মজুরি দিয়েছেন এক হাজার ২০০ টাকা এবং বাজারে নিতে গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন ১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে প্রতি কেজি শিমের দাম ৭-৮ টাকা, তবুও নেই পর্যাপ্ত ক্রেতা। ক্রেতা না থাকায় মাত্র ৩০ টাকার শিম বিক্রি করে বাকি শিম বাজারেই রেখে চলে আসেন। এ বছর মরিচ চাষ করেও তার লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। মরিচের গাছে ফুল আসার আগেই সব গাছের পাতা কোঁকড়ে গিয়েছিল তার।
সবজি চাষীরা শুধু শিম চাষ করেই বিপাকে পড়েননি। ফুলকপি, বাধাকপি, বেগুন, আলু, মুলাসহ প্রায় সব ধরনের সবজি চাষ করেই তারা এবার ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সবজি চাষ করে উৎপাদন খরচ পর্যন্ত উঠছে না তাদের।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাদারগঞ্জ উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া সব ধরনের সবজি চাষের উপযোগী। চলতি মৌসুমে উপজেলার সাত ইউনিয়ন একটি পৌরসভায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষ করা হয়েছে। শীতের এই ভরা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে সবজির চাষ হওয়ায় দাম কিছুটা কম।
১ ফেব্রুয়ারি শনিবার উপজেলার বিভিন্ন খুচরা হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি শিম ৮-১০ টাকা, আলু ২০ টাকা, বেগুন ১০-১৫ টাকা, টমেটো ১৫- ২০ টাকা, গাজর ২০-৩০ টাকা, কাঁচা মরিচ ২০-৩০ টাকা, শশা ৩০ টাকা ও পেঁয়াজ ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার প্রতিটি ফুলকপি ৫ টাকা, বাধা কপি ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সুখনগরী এলাকার ফুলকপি চাষি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এবার ফুলকপিসহ শীতকালীন সবজির প্রচুর ফলন হয়েছে। ৩৩ শতাংশ জমিতে ফুলকপি চাষ করে খরচও তুলতে পারিনি। বাজারে ফুলকপির চাহিদা খবুই কম। চাহিদাকম থাকায় জমি থেকে তোলা হচ্ছে না ফুলকপি। যার ফলে জমিতেই নষ্ট হচ্ছে শীতকালীন এসব সবজি।
চাষী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ফুলকপি বড় হলেও বিক্রি না হওয়ায় গরু-ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু গরু-ছাগলের জন্যও কেউ নিচ্ছে না। তাই ফুলকপিসহ জমি চাষ করে ফেলছি।
ফুলজোড় গ্রামের কৃষক বছির উদ্দিন বলেন, শীতকালীন সবজি চাষ করে এবার কৃষকদের মাথায় হাত। প্রতি বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করতে খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। আর বিক্রি হচ্ছে ৮-১০ হাজার টাকায়। সার, কীটনাশকের দাম বেশি অথচ সবজির দাম নেই। কৃষকদের অবস্থা খুবই খারাপ।
বালিজুড়ী বাজারে আসা ক্রেতা সাইদুর রহমান বলেন, হাটে শীতকালীন সবজির আমদানি প্রচুর। এ জন্য সবজির দাম একেবারেই কম। এবার অনেক কৃষকের সবজি হাটে নিয়ে আসার খরচই উঠছে না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. শাহাদুল ইসলাম বলেন, মাদারগঞ্জ উপজেলায় প্রচুর সবজি উৎপাদিত হলেও কোন সবজি সংরক্ষণাগার নেই। সবজি সংরক্ষণাগার থাকলে কৃষকদের হয়ত এত কম দামে সবজি বিক্রি করতে হত না। সারাদেশে প্রায় একই সময়ে বাজারে উঠছে শীতকালীন শিম, ফুলকপিসহ বিভিন্ন সবজি। এতে স্বাভাবিকভাবেই দর পতন হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আবাদ না করায় ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষকেরা। তাই চাষ করার আগে সঠিক পরিকল্পনা করার প্রয়োজন। আগামী বছর চাষীদের পর্যায়ক্রমে সবজি চাষেরও আহ্বান জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।