‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ। খুব অল্প সময়েই দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন সবার স্বপ্নের নায়ক। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ছিল ক্ষণজন্মা এই নায়কের শুভ জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৫৪ বছরে পা রাখতেন তিনি।
সালমান শাহর পরিবার মনে করে, এই নায়কের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। পরিকল্পিতভাবে ‘হত্যা’ করা হয়েছে তাকে, এমন অভিযোগ এনে সালমানের মা নীলা চৌধুরী আইনের আশ্রয়ও নিয়েছেন। তার অভিযোগের আঙুল, সালমানের স্ত্রী সামিরার দিকে। শুধু তাই নয়, সামিরাকে করা হয়েছে মামলার এক নম্বর আসামিও।
সালমানের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি সামিরা। যা বলেছেন আদালতেই। সংবাদমাধ্যমে দু-একটি সাক্ষাৎকার দিলেও সবসময় চেয়েছেন নিজেকে আড়াল রাখতে। ১৯ সেপ্টেম্বর সালমানের জন্মদিন উপলক্ষে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাতে দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় সালমানের সাবেক স্ত্রী সামিরার। সেখানে সামিরা জোর দিয়ে জানিয়েছেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এর আগেও তিনবার তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
চিত্রনায়ক সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বরাবরই বলে আসছেন, তার চিত্রনায়ক ছেলে আত্মহত্যা করেনি। পরিকল্পিতভাবে তাকে খুন করা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জানিয়েছিলেন, ‘সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন, তাকে খুন করা হয়নি।’ মৃত্যুর ২৬ বছর পরও যেন সালমানের মৃত্যুর রহস্য কাটছে না। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সালমানের হঠাৎ মৃত্যুকে কেউ আত্মহত্যা, কেউ হত্যা বলেছে।
সিনেমাজগতে সালমান শাহ নামে পরিচিত হলেও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এই অভিনেতার পুরো নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি, র্যাব, পিবিআই একে একে মামলাটির তদন্ত করে। চলেছে বিচার বিভাগীয় তদন্তও। সব কটি তদন্ত প্রতিবেদনে একে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলেও প্রতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ার পর পরিবারের আপত্তির (নারাজি) মুখে তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়।
মাত্র ২৫ বছরের জীবন পেয়েছিলেন সালমান শাহ। এই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। বলা যায়, দেশের চলচ্চিত্রে ভিন্নধারার সূচনা হয়েছিল তার হাত ধরেই। ছবিতে তার উপস্থিতি মানেই ছিল নিশ্চিত সাফল্য, প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়া দর্শকের সরব উপস্থিতি। ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য আর জনপ্রিয়তা- দুটোই সমানতালে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। অভিনয়ের স্বতন্ত্র ধারা আর ফ্যাশন সচেতনতা তাকে নিয়ে যায় ভিন্ন এক উচ্চতায়। এভাবে তিনি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষণজন্মা নায়ক সালমান শাহ। দেখতে দেখতে তার মৃত্যুর ২৬ বছর পেরিয়ে গেছে।
সাবেক স্বামী সালমান শাহর মৃত্যু প্রসঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন সামিরা। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সামিরা বলেছেন, ‘আত্মহত্যা যারা করে, তারা তো কিছু বলে করে না। এখন নীলা চৌধুরী বারবার বলেন, সামিরাকে কেন রিমান্ডে নেওয়া হয় না। একটা বাসায় একটা বাচ্চা যখন আত্মহত্যা করে, সে বাচ্চার মা-বাবাকে কি আমরা উঠিয়ে নিয়ে চলে যাই? তাহলে আমাকে কেন উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? ইট ইজ সুইসাইড।’
আপনারা কি সংসার জীবনে সুখী ছিলেন? জানতে চাইলে সামিরা বলেন, ‘কেন না! আমরা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতাম। আমি অনেক হ্যাপি ছিলাম। আমাদের মাঝে মনোমালিন্য হলে ইমন তা ভরিয়ে দিত ভালোবাসা দিয়ে।’
কী হয়েছিল সেদিন (৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬), যার কারণে সালমান আত্মহত্যা করল? সামিরা বলেন, ‘আত্মহত্যা করার মতো তেমন কিছুই হয়নি। সেদিন ওর সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। একটা পর্যায়ে অভিমান করে ও রুমে চলে যায় আর দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি তখন অন্য রুমে ছিলাম। এর মধ্যেই সব কিছু ঘটে যায়। আমার চিৎকার শুনে ফ্লাটের লোকজন ছুটে আসে। খবর পেয়ে ইমনের মা-ও ছুটে আসে। এরপর রুম থেকে বেরিয়ে আসে ওর ঝুলন্ত দেহ।’
কেন এটি সুইসাইড, সেই ব্যাখ্যা নিজেই দিলেন সামিরা। বললেন, ‘ও (ইমন) মেন্টালি সুইসাইডাল বাই নেচার। এর আগে তিনবার সুইসাইডের চেষ্টা করেছে। মেট্রোপলিটন হাসপাতালের রেকর্ড চেক করলে জানা যাবে। ওখানে দুবারের রেকর্ড আছে। আরেক হাসপাতালে একবার আছে। তিনটাই আমার বিয়ের আগে। তিনটা ঘটনাই আমি জানি। একবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে করেছিল। আরেকবার আমাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য করেছে। আরেকবার ওর কিছু একটা হয়েছিল, সেটার জন্যও করেছিল।’
কথা প্রসঙ্গে সামিরা এটাও বললেন, ‘একটা কথা বলতে চাই, ইমন কিন্তু ছবিতে ক্যারিয়ার করতে চায়নি। সে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পড়াশোনা যখন এসএসসি, তখন একটা ঘটনার কারণে, এরশাদ (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ)-সংক্রান্ত, নীলা চৌধুরীকে নিয়ে, সেই ঘটনায় ওই সময় নীলা চৌধুরী জেলেও যান, ময়মনসিংহ কারাগারে ছিলেন। ইমন কিন্তু একদিনও মাকে দেখতে যায়নি জেলে। কেন? তখন তো ওর লাইফে আমি নাই। আমার তো ১৯৯২ সালের ২০ ডিসেম্বর বিয়ে হয়েছে। আর এই ঘটনা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চের দিকের। ইমন কিন্তু তার মাকে মা, আম্মা এসব ডাকত না। মহিলা বলে ডাকত। আমাদের সামনে অবশ্য ওভাবে বলত না। শুটিং সেটে যখন নীলা চৌধুরী যেতেন, তখন ইমন বলত, মহিলা আসছে। ডলি জহুর আন্টি একদিন সেটে থাকা অবস্থায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। তখন বকা দিয়ে ইমনকে বলেছিল, ‘তুই এভাবে ডাকছিস কেন? তোর তো মা হয়।’ ইমন তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।’
সামিরা আরও বলেন, ‘ইমনের মনে অনেক কষ্ট আগে থেকেই ছিল। ইমন অনেক কিছু দেখে বড় হয়েছিল, যেগুলো ওর দেখার দরকার ছিল না। এগুলো নিয়ে বাচ্চাদের হয় কি, আমরা এখন যেমন হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে অনেক পড়াশোনা করি, তখন তো এগুলো করতাম না। তখন আমাদের কোনো কাউন্সেলিংয়ের সুযোগও ছিল না। ছিল না রিহ্যাবিলিটিশেনরও। এখন রিহ্যাব আছে, কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমরা তেমন কিছু অনুভব করলে কারও সঙ্গে আলাপ করে তা ভাঙার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা। তখন তো ইমন এসব কাউকে বলতে পারেনি। সালমান শাহ হওয়ার পর তো আরও বলতে পারেনি। যাকে বলবে, এটা নিউজ হয়ে যাবে।’
মৌসুমী ছিলেন সালমান শাহর প্রথম নায়িকা। কিন্তু খুব বেশি সিনেমাতে দেখা যায়নি তাকে। সালমান শাহর বেশিরভাগ সিনেমার নায়িকা ছিলেন শাবনূর। পরবর্তী সময়ে সালমান শাহ এবং শাবনূরের প্রেমের গুঞ্জনও শোনা যায়। কীভাবে শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহর অভিনয়ের শুরু সে প্রসঙ্গে সামিরা বলেন, ‘সালমান শাহ এবং মৌসুমী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অভিনয় না করার। এই ঘটনার শুরু একটা সিনেমার শুটিং সেট থেকে। শুটিং এর সময়ে খুব ছোট একটা বিষয় নিয়ে মৌসুমীর মা এবং সালমান শাহয়ের মায়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরবর্তীতে সালমান শাহ এবং মৌসুমী সিদ্ধান্ত নেয় তারা একসঙ্গে সিনেমা করবে না। এরপর আমরা নায়িকার সংকটের মধ্যে দিয়ে যাই। তখন শাবনাজ এবং নাইম বিয়ে করেন। বিয়ের পর গুজম শুরু হয় শাবনাজ অভিনয় ছেড়ে দিবেন। তখন তাই নতুন নায়িকা খুঁজতে হয়। পরে আমরা শাবনূরকে দেখার পর সিদ্ধান্ত নেই ওর সঙ্গেই কাজ করা হবে।’
সালমান শাহ এবং শাবনূরের প্রেমের গুঞ্জন নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টা এত সহজে বলা যায় না। এর পেছনে অনেক বড় গল্প আছে। সেই গল্পটা আমি শুরু করলে শেষ করতে অনেক সময় লেগে যাবে। সালমান শাহ এবং শাবনূরের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা তাহলে এমি এক বাক্যে বলবো যে হ্যাঁ তাদের সম্পর্ক ছিল।’
শাবনূরের সঙ্গে সম্পর্কের রেশ ধরে সালমান শাহর সঙ্গে সমস্যা হতো কিনা সে প্রসঙ্গে সামিরা বলেন, ‘হ্যাঁ এই বিষয়টা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। আমি রাগ করে আমার বাবার বাসাতেও চলে গিয়েছিলাম। সালমান শাহ আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল, মাফ চেয়েছিল। আমাকে মানিয়ে নিয়ে আসে। আমি দুইমাস পর ঢাকায় আমাদের বাসায় ফিরে আসি। সালমান শাহ আমাকে বলেছিল সে শাবনূরের সঙ্গে যে সিনেমাগুলোর চুক্তি আছে সেগুলো শেষ হলেই তার সঙ্গে আর কোনো সিনেমায় কাজ করবে না। আমরা নতুন নায়িকা খুঁজব। সে সব কথাগুলো রেখেছিল।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় সালমান শাহের। স্মার্টনেস ও ব্যক্তিত্ববোধের কারণে রাতারাতি তরুণ প্রজন্মের আইকনে পরিণত হন তিনি। চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টি ছবিতে অভিনয় করেন এই নায়ক। যার অধিকাংশই সুপারহিট।সূত্র:ইত্তেফাক।