॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নের সকল সূচকে নারীর অগ্রযাত্রাকে ‘নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে ড. আতিউর রহমান বলেছেন, এখন দরকার ভিত্তিটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর সম্প্রতি বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের ভালো একটা ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এখন দরকার ভিত্তিটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের সামনে এটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। বাংলাদেশে নারীর কল্যাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে এটিই ছিল সর্বপ্রথম পদক্ষেপ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে তারই নির্দেশনায় নারী উন্নয়ন নীতিকে আরও পরিশীলিত করে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ প্রণয়ন করা হয়। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম প্রণীত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী লিঙ্গ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশকে ছাড়িয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে এবং বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে ৭১তম স্থানে রয়েছে।
গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে ‘জেন্ডার বাজেট’ অন্তর্ভূক্ত করার মধ্যে দিয়ে নারী উন্নয়নের এক মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়ন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছে এরূপ ৪টি মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভূক্ত করে প্রথম জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। ক্রমান্বয়ে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ৪০টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ৪৩টি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ৪৪টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীদের চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক সুরক্ষা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতের বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে নারীর ক্ষমতায়নে জেন্ডার সমতা বিধানে পাঁচটি কৌশলগত উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়;-নারীর ক্ষমতার মানোন্নয়ন, নারীদের অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি, নারীদের কন্ঠ ও সংগঠন জোরদার করা, নারীদের অগ্রগতির জন্য একটি অনুকুল পরিবেশ তৈরি এবং মা ও শিশুর সহায়তা ও কর্মসূচি বাড়ানো।
এসব উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের যে পথরেখা তৈরি হয়েছে সেই, পথরেখা ধরে, নারী যাতে আরো সাবলীলভাবে এগিয়ে যেতে পারে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র দশটি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম অগ্রাধিকার উদ্যোগ নারীর ক্ষমতায়ন। পাশাপাশি, আমার বাড়ি আমার খামার, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, বিনিয়োগ বিকাশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ সবক’টি উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে নারীর ক্ষমতায়নের এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
ড. আতিউর রহমান বলেন, “আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পটির একটি বড় লক্ষ্য ছিল নারীর হাতে সঞ্চয় বাড়ানো। এমনিতেই নারী সঞ্চয়মুখী। তারা অল্প টাকার মধ্যেও কিছু টাকা সঞ্চয় করে রাখেন যাতে তাদের সন্তানদের স্কুলের খরচ, ডাক্তারের খরচ লাগলে তারা খরচ করতে পারেন। কিন্তু যখন এটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলো, আমার বাড়ি আমার খামার থেকে একটা ব্যাংকে চলে গেলো, তখন বড় পরিসরে কাজ করবার একটা সুযোগ হলো।’
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক দীপঙ্কর রায় বলেন, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের শুরুতে গড়ে উঠা প্রত্যেক গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ন্যূনতম ৪০ জন নারী সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর ফলে দেখা যায় যে, নিজস্ব সম্পদ কাজে লাগিয়ে যারা এই সমিতির মাধ্যমে সাবলম্বী হয়েছেন তাদের ৬০ শতাংশই নারী। তিনি বলেন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে এখন যদি ৬০ লাখ সদস্য হয়ে থাকে তাহলে তার মধ্যে ৪০ লাখই নারী সদস্য।
ড. আতিউর সদস্যদের সঞ্চয়ের বিপরীতে প্রদেয় ঋণ বিনিয়োগের খাত নির্ধারণ করে দেয়ার মাধ্যমে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দরকার তারা সংখ্যায় বেশি হবেন। নারীদের মধ্যে থেকেই গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সভাপতি নির্বাচন করতে হবে। তাদের হাতে টেকনোলজি দিতে হবে। তাদের সভাপতি যদি একজন নারী হন, তার হাতে যদি একটা স্মার্ট ফোন দেয়া যায়, তিনি যদি হিসেবপাতিগুলো স্মার্ট ফোনে করতে পারেন-তাহলে তিনি যথাযথ ক্ষমতায়িত হবেন।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে ভূমিহীন, গৃহহীন, দুর্দশাগ্রস্থ ও ছিন্নমূল পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমি ও গৃহের মালিকানা স্বত্ব প্রদান করা হয়। পুনর্বাসিত পরিবার যেন ভবিষ্যতে মালিকানা সংক্রান্ত কোন জটিলতায় না পড়েন সেজন্য উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক জমির মালিকানা স্বত্বের রেজিস্টার্ড দলিল/কবুলিয়ত, নামজারি খতিয়ান ও দাখিলাসহ সরেজমিনে দখল হস্তান্তর করা হয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নাম তথ্যআপা। যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায় ) হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় মহিলা সংস্থা ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। জুন ২০২৩ এ কার্যক্রমের মেয়াদ শেষ হবে। এ প্রকল্পের মোট জনবল ২৪৮৪ জন, প্রধান কার্যালয়ে ২৪জন এবং ৪৯২টি তথ্যকেন্দ্রে ২৪৬০ জন। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮৫ কোটি ৭৬ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত।
আটটি বিভাগের ৬৪টি জেলার অন্তর্গত ৪৯২টি উপজেলায় প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবাপ্রদানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নই এ প্রকল্পের লক্ষ্য।
এটুআই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রয়াসের অংশ হিসেবে নারীর তথ্যে অধিকার এবং উদ্যোগগুলোকে যাতে সহজে মেইন স্ট্রিমিং করা যায় প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনে ভিজিটর সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে জনশক্তির অর্ধেক নারী। যাতে নারীরা সহজে আরেক নারীদের সাথে মনের কথা খোলাখুলি ভাবে বলতে পারে সেজন্য এই উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে। মোট সাড়ে ৮ হাজার ভিজিটর সেন্টার আছে, এসব ভিজিটর সেন্টারে ১৬ হাজার উদ্যোক্তা আছে, যার অর্ধেক নারী।
জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতে নারীকে সম্পৃক্ত করার যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই এসব কর্মসূচির মূল লক্ষ্য।সূত্র:বাসস।