বিনা পুঁজিতে লাখ টাকার ঝাল-মুড়ি ব্যবসায় বাজিমাত তিন ভাইয়ের

সুজন সেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেরপুর, বাংলারচিঠিডটকম: বিনা পুঁজিতে মাসে লাখ লাখ টাকার লোভনীয় স্বাদের ঝাল মুড়ি বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তিন ভাই। এই ব্যবসার টাকায় তারা জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা ও বিয়ে দিয়েছেন এই ঝাল মুড়ির ব্যবসার টাকাতেই। ওই ভাইয়েরা হলেন জীবন কৃষ্ণ তুরাহা (৬৩), পরান কৃষ্ণ তুরাহা (৬১) ও মদন কৃষ্ণ তুরাহা (৫৯)। তাদের বাড়ি শেরপুর জেলা শহরের রাজবল্লভপুর এলাকায়। তারা ওই এলাকার মৃত রঙ্গিলা তুরাহার ছেলে।

পরান কৃষ্ণ তুরাহা জানান, আজ থেকে ৪০ বছর আগে শুরু হয় এই ঝাল মুড়ির ব্যবসা। এর আগে তিনি ও তার অন্য দুইভাই বাইসাইকেল মেরামতের কাজ করতেন। এ থেকে যা আয় হতো ওই টাকায় তার সাত সদস্যের পরিবার চালানো অনেক কষ্ট হয়ে যেত। কখনো এক বেলা খেয়েও দিন পার করতে হতো। পরবর্তীতে মোটরবাইকের যুগ চলে আসায় ওই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তারা শুরু করেন পান, বিড়ি ও সিগারেট বিক্রির ব্যবসা। জেলা শহরের গৃদ্দানারায়নপুর এলাকার সত্যবতী সিনেমা হলের উল্টো পাশে ছোট্ট একটি দোকান ভাড়ায় নিয়ে চলছিল এই ব্যবসা। কিন্তু এ ব্যবসাতেও ভালো কিছু করতে পারছিলেননা। যে কারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে কোন রকমে জীবন কাটাতে হচ্ছিল।

পরান কৃষ্ণ তুরাহা আরও জানান, এ অবস্থায় শহরের গোয়ালপট্টি মোড়ে স্থানীয় সম্ভু নাথের ঝাল মুড়ির দোকান দেখে তিনিও এই ব্যবসা শুরু করার মনস্থির করেন। পুঁজির সংকট থাকায় ঝাল মুড়ি তৈরি করার সকল উপকরণ বিভিন্ন দোকান ঘুরে বাকিতে সংগ্রহ করে ব্যবসা শুরু করেন। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খাদ্যমান ও এর স্বাদ অটুট থাকায় দিন দিন এই দোকানের নাম বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে। আর বাড়তে থাকে ক্রেতা সমাগম।

এক প্রশ্নের জবাবে পরান কৃষ্ণ তুরাহা বলেন, তার দোকানে পঁচা-বাসি খাবার বিক্রি হয় না। ঝাল মুড়ি তৈরি করার প্রধান উপকরণ মুড়ি, খাঁটি সরিষার তেল, ডাল, ছোলা, বেগুনি, দেশি পেঁয়াজ, মরিচ, আলু, ডিম ও সয়াবিন তেল দৈনিক কেনা হয়। ওইসব পণ্য বাকিতে কিনে ব্যবসা শেষে রাতের বেলা সব বকেয়া পরিশোধ করা হয়। আর এ খাবারগুলো টাটকা তৈরি করা হয় বলে এর চাহিদাও বেশি থাকে।

আরেক ভাই মদন কৃষ্ণ তুরাহা বলেন, এক সময় আমরা প্রতিদিন দুপুর থেকে রাত একটা পর্যন্ত ঝাল মুড়ি বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় আগের মতো পরিশ্রম করতে পারি না। এখন সন্ধ্যা থেকে দোকান খোলা হয়। এর পরপরই ক্রেতা সাধারণের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন গড়ে ৮০০-৯০০ জন ক্রেতা এখানে ঝাল মুড়ি খেতে আসে। সর্বনিম্ন ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ টাকা প্লেট মূল্যের মুড়ি বিক্রি হয়। আর চাহিদা অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১০-১২ কেজি ছোলা, ৭-১০ কেজি ডাল, ৪-৬ কেজি বেগুনী, ৯-১২ কেজি পেঁয়াজ, ১০-১২ কেজি মুড়ি ও শতাধিক ডিমের প্রয়োজন পড়ে। গড়ে প্রতিদিন বিক্রি হয় ৮০০০-১২০০০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকার উপর ঝাল মুড়ি বিক্রি হয়।

মদন কৃষ্ণ তুরাহা আরও বলেন, এক সময় এই দোকান সত্যবতী হলের সামনে থাকলেও বিভিন্ন কারণে দুইবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। বর্তমানে শহরের মাধবপুর এলাকার শনি মন্দিরের উল্টোপাশে ব্যবসা করছি। এই দোকানটি নিতে মালিককে আড়াই লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি দিতে হয়েছে। আর প্রতিমাসে ভাড়া ছয় হাজার টাকা।

বড় ভাই জীবন কৃষ্ণ তুরাহা বলেন, গরমকালে ঝাল মুড়ি বিক্রি কিছুটা কম হলেও শীতের সময় এই ব্যবসা তিনগুণ বেড়ে যায়। তখন দোকানে বসার জায়গা থাকে না। তখন মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝাল মুড়ি খায়। এই দোকানে গরিব, ধনী সবাই ঝাল মুড়ি খেতে আসে। অনেক সময় আমরা বিনা পয়সায় গরীব মানুষদের মুড়ি খাওয়াই।

সদর উপজেলার কুসুমহাটি এলাকার কৃষক আইনউদ্দীন মোল্লা বলেন, প্রায় দিন কোন না কোন কাজে শহরে আসতে হয়। সারা দিন কাজ শেষে ফেরার পথে এই দোকানের লোভনীয় স্বাদের ঝাল-মুড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরি। গত ৮-১০ বছর যাবত এই দোকানে যাতায়াতের ফলে ওই তিন ভাইয়ের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে।

শেরপুর সরকারি কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সোলায়মান বলেন, একবার বন্ধুদের সাথে পার্শ্ববর্তী জামালপুর শহর থেকে শেরপুর ফেরার পর ভীষণ খিদে পেয়ে যায়। তখন এই দোকানে ঝাল মুড়ি খেতে আসি। এর স্বাদ আর ভুলতে পারিনি। এখন প্রায় দিনই এখানে আসি।

পরান কৃষ্ণ তুরাহা বলেন, এক সময় অর্থাভাবে অনাহারে থাকতে হতো। কিন্তু এখন আর ডাল ভাতের অভাব নেই। নয় সদস্যের পরিবার নিয়ে ভালো আছি। এই ঝাল-মুড়ির ব্যবসার টাকা দিয়ে জমি কিনে বাড়ি করেছি। এক ছেলে প্রদীপ তুরাহা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করেছে। সে এখন সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরেক ছেলে দীপ কৃষ্ণ তুরাহা শেরপুর সরকারি কলেজে বিবিএ বিষয়ে পড়াশোনা করছে। আর এক মেয়ে পূজা রানী তুরাহা পঞ্চম শ্রেণিতে। এছাড়া অন্য ভাইদের ছেলেরা পড়াশোনা করছে। আর এক ভাতিজির বিয়ে হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।

সরকারি কোন দান অনুদান বা সুবিধা চান কিনা এমন প্রশ্নে পরান কৃষ্ণ তুরাহা মুচকি হেসে বলেন, ঈশ্বর আমাদের অনেক ভালো রেখেছে। আমার কোন কিছু চাওয়ার নেই।

sarkar furniture Ad
Green House Ad