উৎপল কান্তি ধর:
পারপাড়া গণহত্যা জামালপুর এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক নৃশংস গণহত্যার নির্মম কাহিনী। ১৯৭১ সালের ২৬ শে জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল পারপাড়া গ্রাম আক্রমণ করে এবং হত্যা করে ২৪ গ্রামবাসীকে। গুলিবিদ্ধ, আহত হয় বহু নারী-পুরুষ ও শিশু। গণহত্যার পর তারা জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় পুরো গ্রাম। বেঁচে যাওয়া মানুষজন পালিয়ে যায় দূরের এলাকায়। নিস্তব্ধতা নেমে আসে গ্রামে।
পারপাড়া ঝিনাই নদীর তীরে এক নিভৃত জনপদ। কাছেই যমুনা। সরিষাবাড়ী থেকে ৬ কিমি দূরে। মূলতঃ হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম। শতকরা ২০ ভাগ মুসলিম।
৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেই উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল গ্রামের লোকজন। ২৫শে মার্চের পর সংঘবদ্ধ হয় মানুষ। পাহারা শুরু হয় গ্রামে। উদ্দেশ্য, গ্রামকে রক্ষা করা।
২৫শে জুলাই নৌকাবোঝাই রাজাকারের দল আসে লুটপাট করার জন্য। গ্রামবাসীরা লাঠি, বর্শা, দা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মহিলারাও সামিল হয় প্রতিরোধে। কোনঠাসা হয়ে গ্রামের এক ইঁদারার পাশে জড়ো হয় রাজাকারের দল। গ্রামের লোকজন পিটিয়ে মারে ৬ রাজাকারকে। বাদবাকি পালিয়ে যায়। পরের দিন জামালপুর থেকে পাকিস্তানী সেনার এক বড়ো দল আসে গ্রামে। নির্বিচারে হত্যা করে গ্রামের লোকজনকে, ২৪ জনকে। পরে, জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয় পুরো গ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধের পর গুলিবিদ্ধ-আহতদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল। এ গণহত্যার কাহিনী ও সাক্ষাৎকার সংরক্ষণ করেছে মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর।
গণহত্যার সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে গ্রামের কেউ কেউ ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসে, বদলা নিতে। এদের একজন করিম।
পারপাড়ার বদর মন্ডল প্রথম নিহত হয় গুলিতে সেদিন। নিহত হওয়ার আগে সে বলে যায়, তোরা লাঠি নিয়ে এগিয়ে যা, খতম কর ওদের।
স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরেও কোন স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়নি এখানে, বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ঝিনাই নদীর তীরে গণহত্যার সেই স্থান থেকে ২০২৩ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে ভোর ছয়টায় শুরু হয় মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের উদ্যোগে পদযাত্রা। পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী তরুণ-কিশোরদের বড়ো দলটি পারপাড়া বধ্যভূমিতে আসার জন্য জাদুঘর থেকে যাত্রা শুরু করে ভোর ছয়টায়, জাতীয় পতাকা এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকা হাতে নিয়ে।
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের কর্মসূচি হিসেবে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে দুই কিলোমিটার পদযাত্রা করা হয়েছে। ২৬শে মার্চ সকালে উপজেলার পারপাড়া বধ্যভূমি থেকে বাউসি মুক্তিযোদ্ধা বিজয় সরণি পর্যন্ত এ পদযাত্রা হয়। জামালপুর মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় পদযাত্রাটি।
মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, পারপাড়া বধ্যভূমি থেকে ২৬শে মার্চ সকাল ছয়টার দিকে পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রা শেষ করা হয় সরিষাবাড়ীর বাউসী বাঙালির মুক্তিযোদ্ধা বিজয় সরণিতে। এরপর অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের ট্রাস্টি ও পরিচালক উৎপল কান্তি ধর। এতে বক্তব্য দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. আলাউদ্দিন, মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের ট্রাস্টি হিল্লোল সরকার প্রমুখ।
মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরের ট্রাস্টি ও পরিচালক উৎপল কান্তি ধর জানান, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ২০১৮ সাল থেকে দেশব্যাপী এ পদযাত্রার আয়োজন করা হচ্ছে এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদারের নেতৃত্বে এবং প্রতি বছরই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ।