পুলিশ স্বামীর বর্বর নির্যাতনে মারাই গেলেন ব্র্যাককর্মী ইয়াসমিন

ইয়াসমিন আক্তার খানম

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
বাংলারচিঠিডটকম

পুলিশ কনস্টেবল স্বামীর বর্বর নির্যাতনের শিকার জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সেই ব্র্যাককর্মী ইয়াসমিন আক্তার খানম (৪১) আর নেই। পুলিশ স্বামী প্রেমানন্দ ক্ষত্রিয় কর্তৃক পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় মারাত্মকভাবে ঝলসে যাওয়া স্ত্রী ইয়াসমিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে টানা ১২ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ জুলাই ভোরে মৃত্যুবরণ করেন। মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে নেত্রকোনা জেলা সদরের সাতপাই রেলক্রসিং এলাকায় নিজ বাড়িতে মরদেহ নিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন মৃত ইয়াসমিনের পরিবারের স্বজনরা।

পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনা জেলা সদরের পৌর এলাকার সাতপাই রেলক্রসিং এলাকার নবাব আলীর মেয়ে ইয়াসমিন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ব্র্যাকের কর্মসূচি সংগঠক পদে চাকরি করতেন। শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানায় কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল প্রেমানন্দ ক্ষত্রিয় তার দ্বিতীয় স্বামী। প্রেমানন্দেরও এটি দ্বিতীয় বিয়ে। প্রেমানন্দ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার সত্যেন্দ্র নাথ ক্ষত্রিয়র ছেলে। ইয়াসমিন আক্তারকে বিয়ের সময় প্রেমানন্দ ক্ষত্রিয় তার নাম রাখেন শোভন আহমেদ। ইয়াসমিনকে বিয়ে করার পরও প্রেমানন্দ ক্ষত্রিয় তার প্রথম স্ত্রী ও এক সন্তানের সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখায় এ নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়াসমিনের সাথে পারিবারিক কলহ দেখা দেয়। এছাড়াও যৌতুক ও স্ত্রীর সম্পত্তির লোভে স্ত্রী ইয়াসমিনকে মাঝে মধ্যেই নির্যাতন করতেন পুলিশ কনস্টেবল প্রেমানন্দ।

পারিবারিক কলহের জের ধরেই গত ৩০ জুন দিবাগত রাতে দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার বাজারিপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় প্রেমানন্দ তার স্ত্রী ইয়াসমিনের সারা শরীরে পেট্টল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তাকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালান। এ সময় ইয়াসমিনের চিৎকারে প্রতিবেশী কয়েকটি বাসার লোকজন সেখানে গিয়ে শরীরে পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে তাকে উদ্ধার করেন এবং তার স্বামী প্রেমানন্দকে আটক করে দেওয়ানগঞ্জ থানায় জানান। রাতেই দেওয়ানগঞ্জ থানা পুলিশ দ্রুত ওই বাসায় গিয়ে পুলিশ কনস্টেবল প্রেমানন্দকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা ব্র্যাক অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার লোকজন ওই বাসায় ছুটে যান। পরে রাতেই ব্র্যাকের উদ্যোগে মুমূর্ষু অবস্থায় ইয়াসমিনকে জরুরি উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। বর্বরোচিত এ ঘটনার বিচার চেয়ে গত ১ জুলাই ইয়াসমিনের সহোদর বড় বোন হাজেরা বেগম বাদী হয়ে পুলিশ কনস্টেবল প্রেমানন্দকে আসামি করে তার বোনকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগে দেওয়ানগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার আসামি পুলিশ কনস্টেবল প্রেমানন্দ বর্তমানে জামালপুর জেলা কারাগারে আটক রয়েছেন।

ইয়াসমিনের সহোদর বোন আসমা আক্তার সেতু এ প্রতিবেদককে জানান, তার বোন ইয়াসমিন গত ১ জুলাই ভোর থেকে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার শরীরের শতকরা ৮০ ভাগ আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়ায় তার অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন ছিল। ১৩ জুলাই ভোর ৬টা ৫০ মিনিটে ইয়াসমিনকে মৃত ঘোষণা করেন সেখানকার চিকিৎসকরা। ১৩ জুলাই বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইয়াসমিনের ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ১৩ জুলাই বিকেল চারটার দিকে মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা নিয়ে যান স্বজনরা। পরে নেত্রকোনা পৌর কবরস্থানে ইয়াসমিনের দাফন সম্পন্ন।

স্বামীর হাতে বর্ববর নির্যাতনের শিকার হয়ে ব্র্যাকের দেওয়ানগঞ্জ অফিসের কর্মসূচি সংগঠক ইয়াসমিন আক্তারের মৃত্যুতে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করে ব্র্যাকের জামালপুর জেলা সমন্বয়ক মো. মুনির হোসেন খান এ প্রতিবেদককে বলেন, ব্র্যকের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে দারিদ্র বিমোচনে এবং মানুষের সেবায় কাজ করেছেন ইয়াসমিন। তার মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। বর্বরোচিত এ ঘটনায় ইয়াসমিন আক্তারের স্বজনরা যাতে ন্যায়বিচার পান ব্র্যাকের পক্ষ থেকে আমরা সেই দাবি জানাচ্ছি।’

দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এম ময়নুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, ১ জুলাই ইয়াসমিন আক্তার খানমের বোন হাজেরা বেগম বাদী হয়ে তার বোনের শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পুলিশ কনস্টেবল প্রেমানন্দ ক্ষত্রিয়কে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। সেই মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিক্রমে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে একজন ম্যাজিস্ট্রেট্রের উপস্থিতিতে ঢাকায় চিকিৎসাধীন ইয়াসমিন আক্তার খানমের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করেছি। আসামি পুলিশ কনস্টেবল প্রেমানন্দ ক্ষত্রিয় জামালপুর জেলা কারাগারে আটক রয়েছেন।

sarkar furniture Ad
Green House Ad