॥ জাহিদুর রহমান উজ্জল ॥
একটি নদীর কাহিনী হতে পারে তার জলরাশি নিয়ে, ঢেউয়ের দোলায় পাল তুলে নৌকা চলার কাহিনী কিংবা জেলেদের জালে রাশিরাশি মাছ ধরার গল্প নিয়ে। কিন্তু আজ শুনাবো একটি মৃত নদীর কাহিনী। যে নদীর নাম বহুবার এসেছে পানি প্রবাহ নিয়ে খবরাখবর। দু’দেশের অনেক অলোচনায় ছিল পানি বন্টন বিষয়ক। রাজনীতির মাঠ গরম করা এই আলোচিত নদীটির নাম তিস্তা।
তিস্তা একটি নদীর নাম, এই নামের সাথে মিশে আছে দু’টি দেশের বিশাল অঞ্চল। নদীটি সিকিমের হিমালয়ের ৭ হাজার ২০০ মিটার সুউচ্চ চিতামু হ্রদ থেকে উৎপত্তি। এই নদী দার্জিলিং এ শিভক গোলা নামক একটি গিরিসস্কটের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নেমে এসে পশ্চিমবঙ্গের দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করেছে। জলপাইগুড়ি পেরিয়ে নিলফামারীর কালিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
তিস্তা প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশে ১২৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হচ্ছে বাকীটা ভারতের মধ্যে।
নদীর বাংলাদেশের অংশটি পানি সংকটে আজ মৃত প্রায়। নাব্যতা হারাতে হারাতে আজ নদীর চিহ্নটুকু হারাতে বসেছে।
১২৫ কিলোমিটরের নদী পথ শুকিয়ে চরায় পরিণত হয়েছে। নদীটি লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারীর নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশে গেছে। ১২৫ কিলোমিটারের নদী পথের চিত্র খুব ভয়াবহ।
কিছুদিন আগে আমি ভারতের দার্জিলিং যাওয়ার পথে নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজে কিছু সময় কাটাই, এই পথ দিয়ে দার্জিলিংয়ে গেলে পুরো তিস্তা নদী দেখা যাবে।
তিস্তা ব্যারেজের পাশে জাল দিয়ে মাছ ধরছে আব্দুস সালাম নামের এক বৃদ্ধ। তিনি জানালেন, আগে তিস্তা নদীতে নৌকা চালাতাম এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকা বন্ধ। তাই বাইরে গিয়ে কৃষি শ্রমিকের কাজ করি। অবসরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। হাটু পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা করছি। বেলা শেষে একশ বা দেড়শ টাকার রোজগারে জীবন কোনো মতে চলে। এই গল্প তিস্তাপাড়ের প্রায় মানুষের। নদীর মতো তারাও বদলে গেছে। বদলে গেছে তাদের জীবনজীবিকা। পরিবেশের মারাত্মক পরিবর্তন ঘটছে। এসবের মূল কারণ নদীর পানি প্রবাহ।
তিস্তায় মাসিক গড় জল অপসারণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৩০ কিউসিক । ২০১৪ সালে ভারত এক চেটিয়াভাবে পানি প্রবাহ বন্ধ করার জন্য তাদের গজলডোবার বাঁধের সবকটি গেইট বন্ধ করে দেয়। ফলে পানি প্রবাহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। শুরু হয় নদী তীরবর্তী এলাকায় মানুষের আহাজারী, জীবনযাত্রা পাল্টে যেতে থাকে দ্রুত। অবস্থাপূর্ণ কৃষকরা হয়ে যায় গৃহহীন, নদীর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন পেশার মানুষ জলের অভাবে পেশা বদলে এলাকা ছেড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলকায় চলে যায়, পরিবেশ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, একরের পর একর জমির ফসল ফলানো বন্ধ হয়ে যায়। মরুঅঞ্চলে পরিণত হতে থাকে এই অব্জল ফসলি জমিগুলি। প্রাণ বৈচিত্রের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বর্ষা মৌসুমে প্রবল বন্যা আর তীব্র¯্রােতে তিস্তার দু’পাড় ভেঙ্গে যায় জনপদের পর জনপদ। মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে পথের ভিখেরী হয়ে যায়। তিস্তাপাড়ের সুখি মানুষগুলি ‘মফিজ’ হয়ে কাজের সন্ধানে ছুটে চলে এক জেলায় থেকে অন্য জেলায়।
তিস্তার পানি প্রবাহের বাধার কারণে তিস্তার গভীরতা ৩২ ফিট থেকে কমে ১৫ ফিটে দাঁড়িয়েছে, যে কারণে নদীর বুকে চরাঞ্চল যেমন বাড়ছে, তেমনই প্রকোপ বাড়ছে বন্যার। যার কারণে বহুগুণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। তিস্তা অববাহিকায় চারটি জেলার প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বলে নদী গবেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তিস্তা পানি প্রবাহ নিয়ে দু’দেশের অনেকবার অলোচনা চলেছে। কিন্তু পানি প্রবাহের কোনো সমাধান হয়নি। ১৯৮৩ সালে জুলাই মাসে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তিস্তার পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ, আর ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকী ২৫ শতাংশ পানি নদীটিতে সংরক্ষিত রাখা হবে।
কিন্তু কীভাবে এই পানির ভাগ হবে তার কোনো দিক নির্দেশনা ছিলনা। দীর্ঘ বছর পর ২০০৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশে তিস্তার জলের ৮০ শতাংশ দু’দেশের মধ্যে সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট জল নদীতে সংরক্ষণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে ভারত অসম্মতি জানিয়ে দেন। ফলে শুরু হয় বড় ধরনের সংকট। তিস্তা পানি প্রবাহের বিষয়টি আবারো ঝুলে থাকে। এই বৈঠকের পর নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে ভারতের জলপাইগুঁড়ি জেলার মালবাজার মহকুমার গজালডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তায় জল প্রবাহ বন্ধ করে দেয়।
২০১৩ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূলপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের তিস্তা নদীতে আসতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা শুধু দেখানো মাত্র।
যাই হোক, এ পারের তিস্তার কথা তো বললাম, এবার ভারতের তিস্তার কথা বলি, বুড়িমারী থেকে সীমান্ত পার হয়ে তিস্তার তীরধরে আমাদের জীপ ছুটে চলছে জলপাইগুঁড়ি জেলার উদ্দেশে। যাবার সময় কয়েকবার তিস্তার দেখা পেয়েছি। কি প্রশস্ত নদী, স্বচ্ছ পানি। ঢেউ খেলানো জলরাশিতে মাছ ধরছে শত শত জেলে, পালতোলা নৌকা চলছে, চলছে ট্রলার। এ সব দৃশ্য দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এপার-ওপার ব্যবধান বুঝতে সময় লাগলো। একই নদী কিন্তু একটি সীমারেখার জন্য এই বৈষম্য কেন? মনে হচ্ছিল গাড়ি থামিয়ে তিস্তার একটু হাওয়া গায়ে লাগাই, এক আচলা স্বচ্ছ জল তুলে দেখি এই জলের কোন পরিবর্তন আছে কি?। কিন্তু ড্রাইভার জানালো, বাবু এখানে কি তিস্তা দেখবেন, তিস্তা তো দেখবেন পাহাড়ে।
ওর কথায় সায় দিয়ে আপাতত তিস্তার হাওয়া খাওয়ার সাধ মিটিয়ে নিলাম, হাতগুটিয়ে নিলাম জলস্পর্শ করতে পারলাম না। দার্জিলিং যাওয়ার পুরো পথতো তিস্তার পাশ দিয়ে। রাস্তার পাশ দিয়ে কি সুন্দরভাবে বয়ে গেছে পাহাড়ী নদী। ওপাশে সবুজ ঘনবন পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় তার নীচে বয়ে চলেছে তিস্তা নামের বহমান নদী। একটু পর পর ব্যারেজ চোখে পড়লো। প্রচুর জলবিদ্যুতের প্রজেক্ট। বড় বড় ব্যারেজ নির্মাণ করে পানি আটকিয়ে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। প্রবাহমান পানিকে ভাটিতে ছেড়ে দিয়ে আবার সেই পানি ঘুরিয়ে উজানে নেয়া হচ্ছে। জলবিদ্যুৎ প্রজেক্টে যাওয়া নিষেধ, ছবি তোলা বা তথ্য কোন কিছু জানা যাবে না। সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তবুও আগ্রহ নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম স্থানীয় অধিবাসীর কাছে শুনলাম, এখানে প্রায় বহু ব্যারেজ ও জলবিদ্যুৎ প্রজেক্ট করা হয়েছে। প্রচুর জল তিস্তায়, তাই জলবিদ্যুৎ প্রজেক্টগুলি এখানেই বেশি করা হয়েছে। এই পানি তো বাংলাদেশে যায় না, এই প্রশ্ন করতেই তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আসলে পানির হিস্যা যে বাংলাদেশ পায় না তা তিস্তা পাড়ের জনগণ জানেই না। জানারও কোন আগ্রহ নেই।
জলবিদ্যুৎ প্রজেক্টগুলিতে টুরিস্ট পরিচয়ে দিয়েও ঢুকতে পারলাম না। মূলত কড়া নিরাপত্তায় ওইসব রাখা হয়। এই প্রজেক্টগুলি নির্মাণ করে তারা তিস্তার পানিকেই দূষিত করছে এমন অভিযোগ ভারতীয় পরিবেশবাদীদের তবুও পাহাড়ের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তিস্তা নদীর বুক চিরে নিত্য নতুন প্রজেক্ট তৈরি হচ্ছে।
দেখেছি তিস্তার উৎসমুখ। তিস্তাবাজার নামের জায়গায় এই নদীর মোহনা রয়েছে। ওই জায়গায় গিয়েও দেখিছি তিস্তায় পানির কোনো ঘাটতি নাই। নদীর দু’কূল ভরে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তাদের সীমানায় প্রবাহমান নদীকে বাধা দিয়ে রেখেছে। নদীতো বহমান উঁচু পাহাড়ের ঝরনাধারা থেকে প্রবাহিত হয়ে সাগরের দিকে ছুটে চলবে এটাই নদীর ধর্ম। নদীতো কোনো বাধা তো মানবেনা কোন দেশ, সীমানা, আইনকানুন, উঁচু, নীচু, সমতল, বনবাদাড়, গ্রাম শহর সাবাইকে ছাড়িয়ে নদী গতিময় হয়ে এগিয়ে যাবে সাগরের দিকে। হোক না অন্যদেশ। এই নদীর কাহিনী লিখতে গিয়ে সেই বিখ্যাত গানটি মনে পড়ে ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, বলো কোথায় তোমার দেশ, তোমার নেইকো চলার শেষ ও নদীরে…
লেখক : সভাপতি, মাদারগঞ্জ প্রেসক্লাব
ও প্রতিনিধি বাংলারচিঠিডটকম