দিল্লির লাড্ডু। দিল্লি এলে ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখার পর ঐতিহ্যবাহী খাবার স্বাদ নিবো না এ কেমন হয়। এক সকালে দিল্লির ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীচকে আমরা দুজনে গেলাম। দিল্লির পুরাতন বাণিজ্যিক এলাকা। বিশাল বাণিজ্যিক এলাকা। কাপড়, গহনা, বিয়ের শেরওয়ানি, কসমেটিকসহ বিভিন্ন পণ্যের বিশাল পসরা সাজিয়ে রেখেছে।
এই এলাকায় সব দোকানের পাশাপশি সারা ভারতবর্ষের নাম করা ও ঐতিহ্যবাহী মিঠাইয়ের দোকান রয়েছে। মিঠাই মানে দিল্লির লাড্ডু। মতিচুর লাড্ডু খেলাম। যে দোকানে খেলাম তার নাম ঘাঁতেওয়ালা হালওয়াই। বয়স ২০০ বছরের ওপরে। এটি ১৭৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি সম্ভবত দিল্লির প্রথম মিষ্টির দোকান।
ভারতবর্ষের মিষ্টির ইতিহাস সুপ্রাচীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি মতিচূরের লাড্ডু। বয়স প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি। আধুনিক সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স মাত্র দুই-আড়াই’শ বছর। ভারতীয়রা দুধ থেকে ছানা তৈরি করতে শিখেছে পর্তুগিজদের কাছ থেকে। তাদের কাছ থেকে বাঙালি ময়রারা ছানা ও পনির তৈরির কৌশল শেখে।
প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে। বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবখাদ্য। বিশেষ করে ননি ও মাখন অত্যন্ত প্রিয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের। এ জন্য দুধ থেকে রূপান্তরিত ওই সব খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু ছানা তৈরি হয় দুধ বিকৃত করে, এ জন্য মনুর বিধানমতে, ছানা ছিল অখাদ্য। এই সব পুরাতন কাহিনী।
সুস্বাদু লাড্ডুর নাম কি করে এলো একটু জানা যাক, লাড্ডু শব্দটি সংস্কৃত শব্দ লাড্ডুকা বা লাত্তিকা থেকে এসেছে যার অর্থ ছোট বল। আর হিন্দিতে মতি শব্দের অর্থ মুক্তা। চুর অর্থ ভাঙ্গা বা চূর্ন-বিচূর্ন করা। অর্থাৎ মতিচুর মানে মুক্তার ভাঙ্গা গুঁড়া। ছোট ছোট মুক্তা দানার মতো বুন্দিয়া বানিয়ে সেগুলোকে একসাথে হাতে চেপে তৈরি হয় মতিচূরের লাড্ডু হয়। আর এইজন্যই এমন চমৎকার নামের নামের উৎপত্তি। মতিচূরের লাড্ডু ভারত উপমহাদেশের একটি প্রাচীন মিষ্টি। এর বয়স দুই হাজার বছরেরও বেশি। ধারণা করা হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে বিহারে এর উৎপত্তি হয়।
সেই থেকে ভারতে এই মতিচূর লাড্ডু জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ঘাঁতেওয়ালা হালওয়াইয়ের লাড্ডুতে খাঁটি গাওয়া ঘি’র স্বাদটুকু বাড়তি পাওনা। এই দোকান ছাড়াও দিল্লিতে হলদি রাম প্রভূজী, বেকারনর ভালা, তেওয়ারী সুইটস, চিন্নাই রাম সিন্ধি, চুন্নি লাল মিঠাই, বাংলা সুইটস, বানসাল মিঠাই প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী। যে কোন মিঠাইয়ের দোকানে মতিচূর লাড্ডডু খেয়ে স্বাদটুকু মুখে লেগে থাকলো।
যে লাড্ডু নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করা হলো তার একটি প্রবাদ সারা ভারতবর্ষে আলোচিত ছিল। ‘দিল্লিকা লাড্ডু জো খায়া ও পস্তায়ে, জো নেহি খায়া ও ভি পস্তায়ে।’
দিল্লীর লাড্ডু খেয়ে আগ্রায় গেলাম তাজমহল দেখলাম, আগ্রাদূর্গ দেখলাম, তাদের ঐতিহ্যবাহী পাথরের কারুকাজময় শিল্পকর্ম কিনে সবকিছু শেষ হলেও একটা প্রধান জিনিস কিন্তু বাকি ছিল। সেটা হল এই এলাকার ঐতিহ্যবাহী সম্রাটদের খাবার, সেই জিনিসটি হলো আগ্রার পিঠা বা মিষ্টি।
যা তাজমহল সৃষ্টির সময় থেকে এই এলাকায় প্রসিদ্ধ। তাজমহল ও দূর্গ দেখার আগে আমাদের গাইড দিল্লি থেকে আসা রাজু গাড়ী থামিয়ে নামিয়ে দিল একটা পিঠার দোকানে। নাম পানচি পিঠা স্টোর। এখানে অনেক রকমের পিঠা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। খুব রসালো, বর্ণাঢ্য রঙিন ওই সব পিঠা দেখেই মন ভরে গেলো। কাজু বাদাম ও জাফরানের নির্যাস মাখানো মাতাল সুবাসে কাছে টেনে নিলো। না খেয়ে আর কি পারা যায়।
এই পিঠার ইতিহাস নিয়ে জনশ্রুতি আছে, তাজমহল তৈরি করতে আসা ২১ হাজার শ্রমিক প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর তাদের ভাগ্যে জুটতো ডাল আর রুটি। একই খাবার প্রতিদিন খেয়ে তারা অসুস্থিবোধ করছিলো। তাদের আবেদন শুনে সন্রাট শাহজাহান তাজমহলের প্রধান নকশাকর ওস্তাদ ইসা সিরাজীর সাথে পরমর্শ করলেন এবং পীর নকশবন্দি সাহেবের সাথে কথা বললেন। পরে পীর সাহেব ওিই রাতে পিঠা তৈরিসহ ৫শ খাবার তৈরির স্বপ্ন দেখলেন। এবং পরে তা তৈরি করে শ্রমিকদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। শ্রমিকদের মন ভরে গেল পিঠা খেয়ে শুরু হলো তাজমহলের কাজ পুরোদমে।
এই রঙিন ও সুবাস মাখানো পিঠা রাজ দরবারের সব উৎসব ও অতিথি আপ্যায়নে পরিবেশন করা হতো। সব সময় মিলতো সম্রাট শাহজাহানের রান্নাঘরে। এই ঐতিহ্যবাহী পিঠা আজ আগ্রায় পাওয়া যায়। যা খাওয়ার সুভাগ্য আমার হয়েছে।
আগ্রার সদর বাজারের বিখ্যাত পিঠার দোকানে ‘পাঁচি’ পিঠা স্টোর চালু করেছিলেন শেঠ পঞ্চম লাল গোয়াল নামে এক ভদ্রলোক। পাঁচি নামে পিঠার ব্যবসা করছে বহুদিন থেকে। তার দোকান ছাড়াও পিঠাওয়ালা আগ্রা, আগ্রা পিঠা স্টোর, রাজভি পিঠা, ব্রীজওয়াসি পিঠা, মুন্না লাল আগারওয়াল পিঠাওয়ালী, সীতারাম পিঠা ভান্ডার, সান্দাল পিঠাঘর এ আপনী এই পিঠাগুলি পাবেন। এই দোকানগুলিতে আপনী নি সন্দেহে পিঠা খেতে পারেন আর বাড়ির জন্য নিতে আসতে পারেন।
লেখক : সভাপতি, মাদারগঞ্জ প্রেসক্লাব
ও বাংলারচিঠিডটকম এর প্রতিনিধি