॥ মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জহিরুল হক বেলাল ॥
[মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জহিরুল হক বেলাল। গ্রামের বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার রানাগাছা ইউনিয়নের গোড়ারকান্দা গ্রামে। তিনি সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের আওতায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে অবদান রাখেন। ‘স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ শিরোনামে লেখাটি মূলত লেখকের আত্মস্মৃতিমূলক যুদ্ধকালীন সেই স্মৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানা চিন্তাভাবনার মত প্রকাশ করেছেন তার এই লেখায়। বাংলারচিঠিডটকমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে তার এই লেখাটি।]
[স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ । পর্ব-১
স্মৃতিতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ । পর্ব-২]
সিলেটের মাধবপুরের যুদ্ধ
এরপর ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব তেলিয়াপাড়া থেকে আমাদেরকে সিলেটের মাধবপুরে নিয়ে আসেন। সেখানে আসার পর আমাদের সাথে বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং আমাদের নিজেদের হারিয়ে যাওয়া কিছু সৈনিক এসে যোগ দেয়। মাধবপুরের দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে পশ্চিম পূর্বপাড় পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সিলেট রাস্তা নিয়ে ডিফেন্স লাগিয়ে দেন। আমাকে এবং ল্যান্সনায়েক আব্দুল মান্নানকে যে স্থানটি নির্বাচন করে দেন সেটি অন্যান্য ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু মাঠ এবং তার উত্তর দিয়ে একটি খাল পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়। আমরা উভয়ই ছিলাম নতুন সৈনিক। আমাকে উত্তর পাশে রাস্তা সংলগ্ন একটি বট গাছের নিচে বাঙ্কার করতে বলেন। এবং আমার থেকে ৫০০/৬০০ গজ দূরে পশ্চিম দিকে আর একজন এলএমজি ম্যান ল্যান্সনায়েক আব্দুল মান্নানকে বট গাছের নিচে বাঙ্কার করতে বলেন। আমাদের এ দুই এলএমজির সাপোর্টের জন্য একজন এইচএমজি সৈনিক কেরামত আলীকে আমাদের ঠিক মাঝামাঝি ৩০০ গজ পিছনে অবস্থান নিতে বলেন।
আমাদের ৮০০ গজ সামনে ঘনবসতি গ্রাম ও গাছপালা ছিল। একটি খাল উত্তর পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে রাস্তা পার হয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে চলে গিয়েছে। গ্রামগুলো থেকে পূর্ব দিকে আমার সামনে নিচু আবাদি ভূমি ছিল। নাসিম সাহেব আমাকে বললেন, তুমি রাস্তা কভার করে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম দিক থেকে যদি কোন পাক আর্মি আসে তাদেরকে আক্রমণ করবে। এবং আব্দুল মান্নানকে বলেন, তুমি পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে গ্রামগুলো কভার করে ফায়ার দিবা। তোমরা দু’জনে একে অপরকে ক্রস ফায়ার দিবে। আর তোমাদের পিছন দিক থেকে এইচএমজি ফায়ার দিবে। আমাদের কোম্পানির প্রত্যেক লোকের অবস্থান দেখিয়ে দিয়ে নির্দেশনা দিয়ে দেন।
আমরা এক রাতের ভিতরেই স্থানীয় সাধারণ লোকদের সহায়তা নিয়ে শেল্টারসহ বাঙ্কার তৈরি করে ফেলি। পরেরদিন সকালে বাঙ্কার দেখে নাসিম সাহেব সন্তুষ্ট হন। বলেন, যদি দেখি পরিস্থিতি খারাপের দিকে তখন আমি ভেরিলাইট পিস্তলের রেডওভার গ্রিন ফায়ার দিলে তোমরা উইড্রল করবে। তার পূর্বে তোমরা ডিফেন্স থেকে উইড্রল করবে না। সম্ভবত যতটা মনে পরে, পরদিন নাসিম সাহেব আমাদের প্রত্যেককে ২০ টাকা করে বেতন দেন। আমরা তাতেই খুশি। কেননা, এ ২০ টাকা খরচ করার মতো কোন দোকানপাট নেই।
আনুমানিক এর দুই-তিনদিন পর পাকআর্মির সম্ভবত একটি ব্রিগেড আমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হয়। মাধবপুরের পশ্চিমের গ্রামগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং লোকজন ভয়ে ছুটাছুটি করে পূর্ব দিকে দৌঁড়াতে থাকে। এমনিভাবে যতবার পাকবাহিনী আমাদেরকে আক্রমণ করেছে ততবারই তারা আমাদের সামনে বাড়ি-ঘর, গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রথমেই তারা অবিরাম আটিলারি গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ওদিকে তাদের পদাতিক বাহিনী আমাদের ডিফেন্সের পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রমণ করা শুরু করে দেয়। এত বড়ো আক্রমণ শুরু করে যে, এ বিশাল আক্রমণের মুখে আমাদের ক্ষুদ্র বাহিনী কোন ক্রমেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। সম্ভবত আধাঘণ্টা উভয় পক্ষের গুলাগুলির পর নাসিম সাহেব উইড্রল সিগন্যাল দিয়ে দিলেন। কিন্তু আমরা দুই এলএমজি ম্যান ছাড়া বাকি সকলকে পিছনের দিকে হটানোর সাহায্যে আমরা উভয়ই ফায়ার দিতে থাকি।
শত্রু আমাদের খুবই নিকটে ৭০০/৮০০ গজের মধ্যে ছিল। তারা ওই গ্রামের ভিতরে জড়ো হচ্ছিল। সম্ভবত তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পাকা রাস্তা অতিক্রম করে আমাদের পিছন দিক থেকে ঘেরাও করবে। কিন্তু আমাদের দুটি এলএমজির জন্য বিশেষ করে আমার এলএমজি পাকা রাস্তা সংলগ্ন থাকার জন্য এবং সামনে খোলা জায়গা থাকায় তারা পাকা রাস্তা দখল করতে পারে নাই। শত্রুপক্ষ ও আমাদের মাঝে প্রচন্ড গেলাগুলি চলছিল। এরই এক ফাঁকে কেরামত ভাই তার লোকসহ এইচএমজি নিয়ে উইড্রল হোন। আমরা তখন এলএমজি ফায়ার দিয়ে পাকবাহিনীকে আটকিয়ে রেখে আমাদের কোম্পানির লোকদের সম্পূর্ণভাবে পিছনে যেতে সাহায্য করতে থাকি। শত্রুপক্ষ আমাদের উপর অবিরাম গোলাগুলি নিক্ষেপ করতেছিল। আমাদের কোম্পানি উইড্রল হবার আধাঘণ্টা পর নাসিম সাহেব যখন দেখলেন আমরা উইড্রল হতে পারছি না তখন তিনি আমাদের বিকিউএমএইচ ফরাজ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে, আমাদের যেখানে এইচএমজি পজিশন ছিল তার নিকটে একটি ছোট ঘর ছিল, সেই ঘরকে আঁড় করে আমাদেরকে ডাকতে শুরু করলেন এবং বললেন, তোমরা জলদি উঠে এসো। আমরা তোমাদেরকে ওভারহেড ফায়ার দিচ্ছি। তখনও শত্রুপক্ষের মুষলধারে গুলিবর্ষণ চলছে। এ পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে বাঙ্কার থেকে উঠব। বাঙ্কার থেকে উঠতে গেলে আমাদের গায়ে গুলি অথবা শেলের টুকরা লাগতে পারে।
আমার চিন্তা ছিল, আমার নিকট যতক্ষণ বুলেট আছে ততক্ষণ আমি যুদ্ধ চালিয়ে যাব। সর্বশেষে দুটি বুলেট রেখে দিব নিজের জন্য। যাতে শত্রুপক্ষ আমাকে জীবিত ধরতে না পারে। বুলেট শেষ হয়ে গেলে তখন মৃত্যুকে স্বীকার করে বাঁচার জন্য উইড্রল হতে চেষ্টা করব। নাসিম সাহেব ব্যার্থ হয়ে আমাদের না নিয়ে ফিরে গেলেন। উনি আমাদের উঠে আসার জন্য আমাদের ব্যাটালিয়ানের মর্টারকে আমাদের থেকে দুই মাইল পিছনে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তিনি চলে যাবার পর আমরা পাক বাহিনীর উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকি। আমাদের গুলি যেহেতু সীমিত সেহেতু চেষ্টা করছি হিসাব করে গুলি খরচ করে শত্রুকে হত্যা করতে। এবং শত্রু পক্ষকে আটকিয়ে রাখতে। আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। একমাত্র তার কাছেই সর্বপ্রকার সাহায্য চাচ্ছি। স্যার চলে যাবার ১৫-২০ মিনিট পর হঠাৎ করে ল্যান্সনায়েক মান্নান তার এলএমজি দ্বারা লং ব্রাশফায়ার শুরু করে। আমি বাঙ্কারের মুখ দিয়ে চেয়ে দেখি আমার বাঙ্কারের সামনে খালের ভিতর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পাকা রাস্তা পর্যন্ত অনেকগুলো পাকসৈনিক একত্রিত হচ্ছে। আমিও তৎক্ষণাৎ কালবিলম্ব না করে আমার এলএমজিকে শক্ত করে ধরে শত্রুর দিকে লক্ষ্য করে ডানে বামে ব্যারেল ঘুরিয়ে এলএমজির লং ব্রাশফায়ার করতে থাকি। ওই সময় ল্যান্সনায়েক মান্নান তার এলএমজি নিয়ে দ্রুত বাঙ্কার থেকে উঠে পাকা রাস্তা পার হওয়ার সময় আমাকে ডাক দিয়ে বলে, জহির ভাই দ্রুত চলে আসুন। এ কথা বলেই সে রাস্তা পার হয়ে নিচে ক্ষেতে নেমে গেল। আমি যখন লং ব্রাশফায়ার করি তখন খালের দিকে চেয়ে দেখি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বহু পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়ে আর্তনাদ করছে। এবং খালের পানি রক্তে লাল হয়ে গেছে।
আব্দুল মান্নান চলে যাবার পর আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই। তখন আমি খেয়াল করে দেখি, আমার গুলির বাক্স প্রায় শেষ। আমি একবার খালের দিকে আরেকবার গ্রামগুলোর দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। ওই স্থানে আমরা দু’জনে সম্ভবত ১০০-১৫০ পাকসেনাকে হত্যা করি। আব্দুল মান্নান চলে যাওয়ার ১০ মিনিট পর আমি চিন্তা করে দেখলাম, এখন আর আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। পাকসেনাদের এতগুলো লাশ দেখে আমি অনেকটাই আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম। এ মুহূর্তে শত্রুর হাতে আমার মৃত্যু হলেও আমার কোন আফসোস নেই। শুধু চিন্তা ছিল আমার এলএমজি নিয়ে। কেননা, এ এলএমজিটা পাকসেনাদের দখলে চলে যাবে। আমি ভালো করেই জানি, এ যুদ্ধে আমার নাম নিশানা চিহ্নও থাকবে না। যেভাবে ওরা গণহত্যা করে যাচ্ছে। কার হিসাব কে রাখে। লক্ষ লক্ষ নিরীহ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করে যাচ্ছে। তার ভিতর আমার মত একজন নতুন সাধারণ সৈনিকের মৃত্যুর খবর কেবা রাখবে। এটাই স্বাভাবিক।
সত্যি বলতে কী, জেনারেল নাসিম সাহেব, আমাকে শত্রুর মুখ থেকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে পরপর ২/৩ বার এগিয়ে এসেছিলেন। তাই আমি তাঁর মতো অধিনায়কের অধীনে থেকে নিজেকে গর্বিত মনে করি। যুদ্ধের ময়দানে আমি সর্বদা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে মোনাজাত করতাম। আর এখনও আমি তাঁর জন্য দোয়া করি। সত্যি বলতে কী, জেনারেল নাসিম সাহেব আমাদের প্রত্যেক সৈনিককে তাঁর প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আমি শুনেছি, তিনি এখনও তখনকার দ্বিতীয় বেঙ্গল ও ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের পেলে প্রাণ খুলে কথা বলেন, কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত তার সাথে আমার আর কোন সাক্ষাত ঘটেনি। কোন এক কারণে গত ২ বছর পূর্বে অর্থাৎ ২০১৭ তে আমি অনেক কষ্ট করে তার বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাসার গার্ড আমাকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। অথচ তিনি তখন বাসায় ছিলেন। আমার উপস্থিতিতেই কয়েক জন উচ্চপদস্থ লোক এসে বাসার ভিতরে গিয়ে দেখা করে আসলেন। ব্যর্থ হয়ে আমি ফিরে আসি। তখন আমার নিকট একটি গানের সংগীতের দুটি কলি মনে পড়ে গেল। ‘বড়ো বড়ো মনীষীদের ভিড়ে তোমাদের নাম হয়তো লেখা থাকবে না … তুবও তোমরা মুক্তিসেনা।’ কথাটি তখন আমার নিকট ধ্রুব সত্য মনে হল। যাই হোক বুঝলাম, যেহেতু তিনি একজন ভিআইপি লোক তাঁর নিকট পৌঁছার আশা করা মানে আকাশের চাঁদ ছোঁয়ার মত কাল্পনিক।
আমি মাধবপুরের ডিফেন্স থেকে উঠার জন্য এলএমজিকে ভালো করে কাপড় দিয়ে পেঁচালাম। সমস্ত খালি বাক্সগুলো প্যাকেটে করে কাঁধে ঝুলালাম। মৃত্যুর চিন্তা না করে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েই বাঙ্কার থেকে বের হলাম। আল্লাহর নাম নিয়ে কালেমা পড়তে পড়তে দৌঁড় দিলাম। কোনরূপে পাকা রাস্তায় উঠে এলএমজি নিয়ে রোলিং করে রাস্তার পূর্ব পাশে নিচে ক্ষেতে পড়ে গেলাম। ওই সময় আমার বাম হাতে বড় ধরনের ব্যথাও পেলাম। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে সেই ব্যথাকে ব্যথা মনে না করে জীবন বাঁচানোর জন্য দৌঁড়াতে লাগলাম। কিছুদূর দৌঁড়াবার পর সেই খালটি আমার চোখে পড়ল। অধিক পিপাসা লাগায় আমি সেই খাল থেকে হাতে পানি উঠিয়ে পান করি। এমন সময় খালের অদূরে চেয়ে দেখি পানির সাথে রক্ত ভেসে আসছে। এ দেখে আমি আর পানি পান করি নাই। খাল পার হয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে দৌঁড় দিলাম। তারপর দেখলাম, কতগুলো ছোট ছেলেমেয়ে শরণার্থী ক্যাম্প থেকে এসে পানি জগ গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলাম, ইতিপূর্বেও আমাদের লোকগুলো এ পথেই এসেছিল। তাদের কেও ওরা পানি পান করিয়েছে।
আমি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এত ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত হয়েছিলাম যে, আমি মনে করেছিলাম, পানির অভাবে আমার জীবন এখনই বের হয়ে যাবে। আমি একটি ছোট মেয়ের কাছ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে পান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম ঠিক ওই মুহূর্তে নাসিম সাহেব ধমকের সুরে আমাকে পানি পান করতে মানা করলেন। আমার আর পানি পান করা হলো না। আমি ক্ষেতের উপর শুয়ে পড়ি। একটু বিশ্রামের পর আমাকে লবণের পানি পান করতে দেওয়া হল। পানি পান করার পর আমি আব্দুল মান্নানকে দেখতে পেলাম। সে আমার কাছেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। চেয়ে দেখি, ওর দু’হাতের চামড়া এলএমজির ব্যারেলের সাথে আটকে রয়েছে। ওর হাতের দিকে তাকালে গা শিউরে উঠে। শুধু হাতের তালুর ও আঙ্গুলের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। জেনারেল নাসিম সাহেব ওকে তৎক্ষণাৎ (সম্ভবত) আগরতলা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এ সময়ে আমাদেরকে দেখার জন্য বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ আর্মি কর্মকর্তারাও সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সম্ভবত জেনারেল সফিউল্লাহ সাহেবও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ল্যান্সনায়েক আব্দুল মান্নানের সাথে সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমার আর সাক্ষাত হয়নি। তার কোন সংবাদও আমি পাইনি।
মাধবপুরের আক্রমণের পর আমরা আর স্থায়ী ডিফেন্স তৈরি করিনি। এরপর থেকে অস্থায়ী ডিফেন্স নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হতাম। দিনের বেলা যার যার অবস্থানে থাকতাম। রাতের বেলা নিজেদের সুবিধা মত জায়গা বেছে নিয়ে হাইড-আউট-এ অবস্থান করতাম। এ অবস্থার মাঝেও আমাদেরকে মাঝে মাঝে ছোট ছোট দল তৈরি করে রাতের বেলা রেড, অ্যাম্বুশসহ বিভিন্ন অপারেশন করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিতেন। চলবে …