জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, জামালপুর
বাংলারচিঠিডটকম
চিকিৎসকের অবহেলায় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে দুটি দরিদ্র পরিবারের নবজাতক দুই কন্যাশিশু মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। তাদের মধ্যে এক শিশুর বয়স নয়দিন এবং অন্যটির বয়স মাত্র দুই দিন। অক্সিজেন মাস্ক লাগানোর কয়েক মিনিটের ব্যবধানে শিশু দুটি মারা যায়। তবে শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক দুই শিশুর চিকিৎসায় কোনো অবহেলা করা হয়নি বলে দাবি করেছেন।
মৃত দুই শিশুর পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলো- জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের ঝালরচর এলাকার দরিদ্র শফিকুল ইসলাম ও রিনা আক্তার দম্পতির নয়দিনের কন্যাশিশু সামিয়া। মৃত অন্য শিশুটি ইসলামপুর উপজেলার গুঠাইল এলাকার হতদরিদ্র সোবহান ও হেনা বেগম দম্পতির দু’দিনের কন্যাশিশু। তার নাম রাখা হয়নি।
তাদের মধ্যে মৃত শিশু সামিয়ার মা রিনা আক্তার অভিযোগ করে জানান, নয়দিন হলো তার মেয়েটি বাড়িতেই স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেয়। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১২ সেপ্টেম্বর দুপুরে সামিয়াকে নিয়ে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করান। একই দিন জেলার ইসলামপুর থেকে হেনা বেগম তার দুই দিন বয়সের মেয়েকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় একই ওয়ার্ডে ভর্তি করান।
দুই শিশুর মায়ের অভিযোগ, শিশু দুটিকে স্যালাইন ঠিকঠাক মতো দেওয়া হলেও অক্সিজেন দেওয়া হয়নি ঠিক মতো। রাত সাড়ে ৮টার দিকে দুই শিশুকেই অক্সিজেন দেওয়া শুরু হয়। প্রথমে সামিয়ার নাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগানোর সাথে সাথেই সে মারা যায়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে অন্যশিশুটিও মারা যায়। একদিকে দরিদ্র এবং উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা, অন্যদিকে শিশু দুটির পিতা বা অন্য কোনো পুরুষ অভিভাবক সাথে না থাকায় তারা আরো বেশি বিপাকে পড়েন। পরে তারা বাড়িতে খবর দিলে স্বজনরা এসে দাফন করার জন্য মৃত শিশু দুটিকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতেই তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। তারা এ ঘটনার সাথে জড়িতদের উপযুক্ত বিচার দাবি করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অক্সিজেনের সমস্যার কারণে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ তুলে তাদের স্বজনরা আহাজারি শুরু করলে ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অন্যান্য শিশুর স্বজনরাও ভয়ে তাদের শিশুদের অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলেন। এতে করে আরো কয়েকটি শিশু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়াসহ শিশু ওয়ার্ডে এক অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে নার্সরা রোগীর স্বজনদের বুঝিয়ে অক্সিজেন মাস্ক লাগানোর ব্যবস্থা করেন।
১২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতালের চারতলায় শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, মারা যাওয়ার এক ঘন্টা হয়ে গেলেও শিশু দুটির মরদেহ থেকে স্যালাইনের সুই ও নল খুলে দেওয়া হয়নি। দুই শিশুর মৃত্যুতে উৎসুক মানুষ সেখানে ভিড় করেছেন। বহিরাগত ও রোগীর স্বজনদের চাপ ও ওয়ার্ডের নিরাপত্তার স্বার্থে ওয়ার্ডের কেচিগেটে তালা দেওয়া হয়। তখনো হাসপাতালের দু’জন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার মধ্যে একজনকেও সেখানে দেখা যায়নি। শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা শিশুরোগ বিষয়ক জুনিয়র কনসাল্টেন্ট চিকিৎসক মো. তাজুল ইসলামকে ওয়ার্ডে পাওয়া যায়নি। একদিকে মৃত দুই শিশুর স্বজনদের উচ্চস্বরে আহাজারি, অন্যদিকে ওয়ার্ডে বিশৃংখল পরিস্থিতিতে অন্যান্য শিশুরোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়।
এক পর্যায়ে রাত পৌনে ১০টার দিকে শিশুরোগ বিষয়ক জুনিয়র কনসাল্টেন্ট চিকিৎসক মো. তাজুল ইসলাম ওয়ার্ডে যান। অক্সিজেন দেওয়া নিয়ে সমস্যার কারণে দুই নবজাতকের মৃত্যুর বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বাংলারচিঠিডটকমকে বলেন, ‘শিশু দুটি ছিলো খুবই কম ওজনের এবং তাদের মাথায় রক্তক্ষরণ সমস্যা ছিল। এ ধরনের শিশুদের শতকরা ৮০ ভাগ সম্ভাবনা থাকে মারা যাওয়ার। রোগীর স্বজনদের ধারণা স্যালাইন আর অক্সিজেন একসাথে দেওয়ার কারণেই মারা গেছে। কিন্তু তাদের ধারণা সঠিক নয়। জীবন রক্ষায় অধিকাংশ শিশুকেই এখানে স্যালাইন এবং অক্সিজেন দিয়েই থাকি। শিশু দুটিকে স্যালাইন এবং অক্সিজেন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি করা হয়নি।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) চিকিৎসক কে এম শফিকুজ্জামান ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে বাংলারচিঠিডটকমকে বলেন, ‘হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে দুই শিশুর মৃত্যুর কথা শুনে রাতেই আমি শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক জুনিয়র কনসাল্টেন্ট মো. তাজুল ইসলামকে দ্রুত ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। তিনি সেখানে গিয়ে শিশু দুটির মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করে এবং চিকিৎসায় কোনো অবহেলা করা হয়নি বলে সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন। ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকার কারণে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারছি না। ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’