কিডনি ক্যানসারের নীরব লক্ষণ

বাংলারচিঠি ডটকম ডেস্ক : কিডনি আমাদের শরীরের অন্যতম একটি ভাইটাল অরগান বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, কিডনি বিকল হলে মৃত্যু নিশ্চিত। তাই কিডনি নিয়ে একটু সচেতনতা দরকার। মানবদেহে কোমরের দু’পাশে দুটি কিডনি থাকে। নানা কারণে আমাদের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি কিডনি বিকল পর্যন্ত হতে পারে। কিডনী রোগের প্রাদুর্ভাব আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। সমগ্র বিশ্বের সাথে সাথে ভারতেও এখন কিডনী রোগ পরিস্থিতি ভয়াবহ।

প্রতিদিন যেসব কারণে কিডনির ক্ষতি হয় তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণটি হলো পর্যাপ্ত পানি পান না করা। কিডনির অন্যতম প্রধান কাজ শরীর থেকে পরিপাক প্রক্রিয়ার বর্জ্য অপসারণ করা এবং লোহিত রক্তকণিকার ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু পর্যাপ্ত পানি পান না করলে বৃক্বের রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এর ফলে রক্তে দূষিত রাসায়নিক জমা হতে থাকে। কিডনি ক্যানসার হলে এসব টিউবিউলের কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং ক্যানসারের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

ইউডব্লিউ কার্বোন ক্যানসার সেন্টারের সদস্য এবং ইউরোলজিক সার্জন জেসন আবেল বলেন, ‘সবচেয়ে কমন টাইপ হচ্ছে রেনাল সেল ক্যানসার, যা টিউবিউলে সৃষ্টি হয়।’

* কিডনি ক্যানসারের কারণ কি?

কখনো কখনো কিডনি ক্যানসার বংশগত হতে পারে। কিন্তু এ ক্যানসারের সবচেয়ে কমন কারণ হচ্ছে ধূমপান, বলেন ডা. আবেল। প্রকৃতপক্ষে, আপনি কত বেশি ধূমপান করেন তার ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকি বেড়ে যাবে এবং এ ক্যানসারের ঝুঁকি এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে ধূমপান বর্জন করা, আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি অনুসারে। অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ ও ব্যথানাশক ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি অপব্যবহার অন্তর্ভুক্ত।

কিডনি রোগের যেকোনো ষ্টেজের জন্যই কিডনি রোগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনই হচ্ছে এই রোগ নিরাময়ের মূল শক্তি। কিডনি রোগের লক্ষণ গুলো সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা থাকলে সেই অনুযায়ী নিরাময়ের ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়। আপনার অথবা আপনার পরিচিত কারো যদি কিডনি রোগের এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা যায় তাহলে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ব্লাড ও ইউরিন টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হোন।

কিডনি ক্যানসারের গোপন লক্ষণ

১. পেটে, পেটের উভয়পাশে অথবা নিচের পিঠে ফোলা :

কিডনি ক্যানসারের শুরুটা সম্পর্কে আপনি নাও জানতে পারেন। যেহেতু কিডনি আপনার শরীরের খুব গভীরে অবস্থিত, তাই রোগীরা এ ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গ অনুভব করে না বললেই চলে, বলেন ডা. আবেল। বিরল ক্ষেত্রে, কোনো রোগী কিডনি ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে টিউমার অনুভব করতে পারেন; যদি এমনটা ঘটে তাহলে তিনি সম্ভবত অগ্রসর পর্যায়ে আছেন।

২. টেস্টে কিছু ধরা পড়ে :

এর মানে হলো, ক্যানসারটি সবসময় দেরিতে ধরা পড়ে না। লোকজন সম্পূর্ণ অসম্পর্কিত কারণে (যা টিউমার প্রকাশ করে) এমআরআই অথবা আল্ট্রাসাউন্ডের মতো ইমেজিং স্ক্যান করতে পারেন, তাই এসব রোগীর এসব ক্যানসার খুব ছোট থাকা অবস্থায় নির্ণীত হয়, বলেন ডা. আবেল। এটি একটি ভালো বিষয়- প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকৃত ক্যানসার অধিক কার্যকরভাবে চিকিৎসা করা যায়।

৩. অল্প পার্শ্ব ব্যথা :

কখনো কখনো কোনো রোগী কিডনি ক্যানসারের একটি লক্ষণ হিসেবে পার্শ্ব ব্যথা অনুভব করতে পারেন। অনবরত পার্শ্ব ব্যথা যা দীর্ঘস্থায়ী ও চলে যায় না তা চিকিৎসক দ্বারা মূল্যায়ন করা উচিৎ। তবে নিজে নিজে ধারণা করবেন না যে আপনার ক্যানসার হয়েছে, কারণ অন্যান্য কিছু মেডিক্যাল কন্ডিশনের কারণেও আপনার পেটের উভয়পাশে ব্যথা হতে পারে।

৪. মূত্রে রক্ত :

এটি কিডনি ক্যানসারের কোনো ছোট লক্ষণ নয়, মূত্রে রক্তের উপস্থিতি ভীতিকর। কিন্তু আপনি জানেন না যে, এটি কতটা মারাত্মক বা বিপজ্জনক, কারণ অন্যান্য কিছু সমস্যার (যেমন- মূত্রনালীর সংক্রমণ) কারণেও মূত্রের সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে। অথবা হয়তো এটি রক্ত নয়, আপনি হয়তো মূত্র লাল করতে পারে এমন খাবার বেশি খেয়েছেন। কিন্তু যদি কিডনি ক্যানসারের কারণে মূত্রে রক্তের উপস্থিতি হয়, তাহলে আপনার ক্যানসার সম্ভবত অধিক অগ্রসর পর্যায়ে আছে, মায়ো ক্লিনিক অনুসারে। এ লক্ষণটি আপনার চিকিৎসক দ্বারা মূল্যায়ন করুন।

৫. ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া :

ক্লান্তি, ক্ষুধা কমে যাওয়া এবং অপ্রত্যাশিত ওজন হ্রাস হচ্ছে কিডনি ক্যানসারের অগ্রসর পর্যায়ের তিনটি বাড়তি উপসর্গ, মায়ো ক্লিনিক অনুসারে। কিন্তু এগুলো বিশেষভাবে গোপন। অন্যান্য ফ্যাক্টরও বিবেচনা করুন, যা আপনাকে ক্লান্ত করতে পারে ও ওজন কমাতে প্ররোচিত করতে পারে- এমনকি স্ট্রেসও এসবের জন্য দায়ী হতে পারে। যদি আপনি ভালো ঘুমানো সত্ত্বেও ক্লান্তির সঙ্গে লড়েন কিংবা কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই ওজন হারাতে থাকেন, তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া সবসময় ভালো সিদ্ধান্ত।

৬. রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া :

এতদিন ধরে আপনার রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় ছিল? রুটিন চেকআপে রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে? তাহলে এটি কিডনি ক্যানসারের একটি লক্ষণ হতে পারে, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক অনুসারে। আপনার কিডনি শরীরে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং রেনিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখে- ক্যানসার এ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। আপনার মধ্যে প্রকাশমান অন্যান্য উপসর্গ সম্পর্কে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন যাতে রক্তচাপ বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ জানা যায়।

৭. রক্তস্বল্পতা :

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনার ক্লান্তির একটি কারণ হতে পারে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যাওয়া। কিডনি দ্বারা নিঃসরিত হরমোন এরিথ্রোপয়েইটিন আপনার বোন ম্যারোকে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে প্ররোচিত করে। আপনার শরীরের অন্যান্য অংশে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য আপনি লোহিত রক্তকণিকার ওপর নির্ভরশীল, যখন তাদের সংখ্যা কমে যাবে আপনার শক্তিও কমে যাবে।

৮. ঠাণ্ডা, ফ্লু বা অন্যান্য ইনফেকশন ছাড়া জ্বর :

যেকোনো সময় শারীরিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি লক্ষণ হতে পারে যে আপনার ইমিউন সিস্টেম কিছু অনধিকারপ্রবেশকারীর সঙ্গে লড়ছে- এটি হতে পারে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া অথবা সম্ভাব্য টিউমার। যদি আপনার রাতে ঘাম হয় অথবা হট ফ্লাশ অনুভব করেন, তাহলে শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করুন। যদি অন্যান্য ইনফেকশনের স্পষ্ট উপসর্গ (কাশি, হাঁচি বা মাংসপেশি ব্যথা- ঠাণ্ডা ও ফ্লু’র লক্ষণ) ছাড়া জ্বর আসে তাহলে তা চিকিৎসক দ্বারা মূল্যায়ন হওয়া উচিৎ।

৯. ডান অণ্ডকোষের চারপাশে শিরা ফুলে যাওয়া :

আপনার যেকোনো অণ্ডকোষে ক্যানসারের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে, বিশেষ করে ডান অণ্ডকোষে। ডান অণ্ডকোষে ভ্যারিকোসিল (স্ফীত শিরার গুচ্ছ) হতে পারে বড় কিডনি টিউমারের লক্ষণ, ক্যানসার ডটনেট অনুসারে। মনের সন্দেহ দূর করতে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

* কিভাবে কিডনি ক্যানসারের চিকিৎসা করবেন?

ডা. আবেল বলেন, ‘গত দশক থেকে কিডনি ক্যানসারের চিকিৎসায় বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। সর্বশেষ চিকিৎসা হচ্ছে ইমিউনোথেরাপি: এটি টিউমার শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করতে আপনার ইমিউন সিস্টেমের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।’ সম্প্রতি দুটি ওষুধ (নিভোলুম্যাভ ও ইপিলিমুম্যাব) অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং তা এ ক্যানসারের অগ্রসর পর্যায়ের রোগী ও আরোগ্যলাভ হচ্ছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

* সার্জারি করা যাবে?

যেহেতু কিডনি ক্যানসার ডায়াগনোসিসের গড় বয়স ৬৪, অর্ধেক কিডনি ক্যানসার রোগীর বয়স ৬৫ এর ওপর, যার ফলে তাদের সার্জারি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাদের টিউমার অপসারণ করা যেতে পারে যাদের টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়েছে, বলেন ডা. আবেল। অন্যদিকে যেসব রোগীর হৃদরোগ বা ফুসফুসের রোগও থাকে, তাদের সার্জারি আরো বিপজ্জনক হতে পারে। আপনার চিকিৎসক টিউমার ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ইতিহাস বিশ্লেষণ করে সার্জারির ঝুঁকি বনাম উপকারিতা মূল্যায়ন করবেন।

* কিডনি ক্যানসার নিরাময় হয়?

অন্যান্য ক্যানসারের মতো এটিও নির্ভর করছে এটি কখন ধরা পড়েছে তার ওপর: যদি কিডনি ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে (স্টেজ ১) নির্ণীত হয়, তাহলে দশ বছরের মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ রোগী প্রাথমিক চিকিৎসায় নিরাময় লাভ করে, বলেন ডা. আবেল। তিনি যোগ করেন, ‘যদি এ ক্যানসার অ্যাডভান্সড ও মেটাস্ট্যাটিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, তাহলে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ রোগী পাঁচ থেকে ১০ বছর পরও বাঁচতে পারে। এটি মেটাস্ট্যাটিক (ছড়িয়ে পড়লে) হলে খুব আক্রমণাত্মক রোগ।’ সূত্র : বিবার্তা