বাংলারচিঠি ডটকম ডেস্ক॥
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ নভেম্বর সকালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নৌঘাঁটি হিসেবে ‘বিএনএস শেখ মুজিব’-এর কমিশনিং করেছেন। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই প্রথম কোন নৌঘাঁটির কমিশনিং করা হলো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সঙ্গে অনুষ্ঠানস্থল থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ২২টি বহুতল ভবন উদ্বোধন করেন এবং সাভারে বিএন টাউনশিপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ভিডিও কনফারেন্সে স্থানীয় এরিয়া কমান্ডার, নৌবাহিনী কর্মকর্তা এবং তাঁদের সহধর্মিনীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
সাভারে চীনা কোম্পানি এই বিএন টাউনশিপ নির্মাণ করবে। এর আওতায় ১০টি ২৭ তলা এবং ১২টি ২৬ তলা অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত আবাসিক ভবন নির্মিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ক্রমবিকাশ এবং জাতি গঠনে তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ নেভি ইন দি টুয়েন্টি ফাষ্ট সেঞ্চুরি’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদসহ উর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বিএনএস শেখ মুজিবের কমান্ডিং কর্মকর্তা মইনুদ্দিন মালিক প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে কমিশনিং ফরমান গ্রহণ করেন।
এরআগে প্রধানমন্ত্রী এই নতুর নৌঘাঁটিতে পৌঁছলে তাকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয় এবং এ সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, বানৌজা শেখ মুজিব ঘাঁটি নিজস্ব অপারেশনাল কর্মকান্ডের পাশপাশি জনকল্যাণ এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, ঢাকা নৌঅঞ্চলে নৌবাহিনী সদরদপ্তর, একটি ছোট ঘাঁটি ব্যতীত আর কোন স্থাপনা আগে ছিল না। কাজেই ২০০৯ থেকে ২০১৮ এই সময়ের মধ্যে এই নৌবাহিনীকে বিভিন্নভাবে আমরা শাক্তিশালী করেছি এবং আন্তর্জাতিকমানের উপযুক্ত করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি নৌবাহিনীর সদস্যবৃন্দকে বলবো, নৌবাহিনীতে দীর্ঘদিন যাবত মাসম্পন্ন প্রশিক্ষণ স্থাপনা, কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং নাবিকদের আবাসিক ভবন ছিল না, তাদের তীব্র সংকটের মধ্যদিয়ে দিন যাপন করতে হয়েছে এবং আজকে যে সমস্যাটির কিছুটা হলেও সমাধান হয়েছে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনা নৌ অঞ্চলে আমরা এ সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি।
পুণরায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে নৌবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলা তাঁর সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভবিষ্যতে ইনশাল্লাহ আবার যদি আমরা আসতে পারি নিশ্চয়ই আমরা এই নৌবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তুলবো, সে লক্ষ্য আমাদের রয়েছে।’
তিনি নৌবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা চাই যারা আমার দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য কাজ করবেন, যারা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্ত্র প্রহরী, তাঁরা এবং তাঁদের পরিবারবর্গ সুন্দরভাবে বসবাস করবেন, সুন্দরভাবে জীবন যাপন করবেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করবেন-সেটাই আমাদের লক্ষ্য,’ যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, জাতির পিতা চেয়েছিলেন একটি আধুনিক উন্নত বাংলাদেশ গড়তে এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে। তাই তিনি সশস্ত্র বাহিনীর একটা প্রতিরক্ষা নীতিমালা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা সে সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশ সীমিত অর্থ, একটা টাকাও কোর রিজার্ভ মানি ছিল না, গোলায় ধান ছিল না, তারওপর এককোটি মানুষ শরণার্থী, তিন কোটি মানুষ গৃহহারা লাখো মা-বোন নির্যাতিতা, আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবার-তাদের পুণর্বাসন এবং একটি বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার মত কঠিন দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তিনি এই নৌবাহিনীও গড়ে তোলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই এই নৌবাহিনী গড়ে ওঠে। এমনকি ’৭৪ সালে তিনি নৌবাহিনীর বৃহত্তম প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বানৌজা ঈশা খান কমিশনিং করেন এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে নেভাল এনসাইন প্রদান করেন।
একই সময়ে তিনি দেশের সমুদ্র সীমা নির্ধারণের জন্য ১৯৭৪ সালে ‘দি টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অব মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন। যা জাতিসংঘ করেছিল ১৯৮২ সালে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকার প্রধান বলেন, জাতির পিতা চেয়েছেন দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করতে এবং আমাদের সশ¯্র বাহিনীকে আরো আধুনিক করতে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য ’৭৫ এর ১৫ আগষ্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশ তাঁর কাঙ্খিত উন্নয়ন অর্জন করতে পারে নাই। যার ফলে আমরা পিছিয়ে গেছি।
তিনি বলেন, ’৯৬ সালে ২১ বছর পর যখন আমরা সরকার গঠন করি তখন আমাদের নৌবাহিনীর জন্য প্রথম অতি আধুনিক ফ্রিগেট আমি ক্রয় করেছিলাম। অন্যান্য যুদ্ধ জাহাজ এবং আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত করে একে আধুনিকায়নের পদক্ষেপ আমরা নিয়েছিলাম এবং নৌবাহিনীকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলারও পরিকল্পনা আমাদের ছিল।’
শেখ হাসিনা বলেন, মাত্র ৫ বছর সরকারে ছিলাম। তার মাঝে যতটুকু করা সম্ভব করেছিলাম। এরপর যখন আবার ২০০৯ সালে সরকারে আসি তখন থেকে আবার আমরা এই নৌবাহিনীর উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি। ২০০৯ থেকে ২০১৮-এই সময়ের মধ্যেই আজকের নৌবাহিনী গড়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্পন্ন ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে নৌকাহিনী গড়ে উঠায় তিনি এই বাহিনীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে যেমন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন আমরা করে যাচ্ছি, অর্থনৈতিকভাবে দেশকে মজবুত করছি অপরদিকে আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক এই বাহিনীগুলিকে আরো উন্নত মানের করায় আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে। যাতে আমরা বিশ্বে একটা মর্যাদা নিয়ে চলতে পারি।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবো, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত দেশ হিসেবে, ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, আমরা ২০২০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়কে মুজিব বর্ষ ঘোষণা দিয়েছি। এরমধ্যেই বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে ইনশাল্লাহ। আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নত দেশ।
তিনি বলেন, আমরা এখানেই থেমে থাকবো না, আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। ২১০০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত করার জন্য আমরা ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ প্রণয়ন করেছি এবং ইনশাল্লাহ আমরা তা বাস্তবায়ন করবো।
সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে এগিয়ে যাবে সেই সঙ্গে আমাদের নৌবাহিনীও- যে নৌবাহিনীর কথা জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৬ দফাতেও উল্লেখ ছিল- নৌবাহিনীর ঘাঁটি এই বাংলার মাটিতেই হতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা একটা পুর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি এবং নৌবাহিনীর সদসদের আর্থসামাজিক সমস্যা মেটানোসহ তাঁদের জন্য কল্যাণমূলক কাজ, যা যা করা দরকার তা আমরা করতে সমর্থ হয়েছি।
তিনি নৌবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের জীবনমানের উন্নয়ন কামনা করে যেসব স্থাপনা করা হয়েছে সেগুলো রক্ষনাবেক্ষণে সকলের প্রতি যত্নবান হবার আহবান জানান।
সূত্র : বাসস