জামালপুর পরিচ্ছন্ন নগর গঠনের তীব্র ঝুঁকি বর্জ্য ও সদিচ্ছার সঙ্কট : প্রয়োজন গণজাগরণ

জামালপুর পৌরসভার কাছারীপাড়া মেষ্টা খানবাড়ি সংলগ্ন উন্মুক্ত স্থানে রাস্তার পাশে মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতিকর ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। ১০ জুন বিকেলের ছবি। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

জাহাঙ্গীর সেলিম:

আমার ধারাবাহিক লেখায় কতিপয়জনের গাত্রদাহ হলেও নিরেট বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ালে সাধারণ ও সরল কোন ব্যক্তির মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার হবে। কতটা নোংরা পরিবেশ হলে সাধারণ পথচারীরা নাকে রুমাল চেপে পথে চলাচল করে থাকেন। এটা আমাদের প্রাণের শহর জামালপুরে আসা, যাওয়া দেশি, বিদেশি মানুষের প্রতিক্রিয়া শুনলেই উপলব্ধি করা যায়।

জামালপুরের মতো শান্তিপ্রিয় শহরের এখন অন্যতম দুঃখ যত্রতত্র আবর্জনা আর সড়ক দখল করে নির্মাণ সামগ্রী রেখে যানবাহন যাতায়াতে চরম বিঘ্ন ঘটানো। পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের অসহনীয় এবং অনিয়ন্ত্রিত চলাচল।

জামালপুর পৌর শহরের শতাধিক স্থান ঘুরে দেখা গেছে ছোট, বড় ময়লার ভাগাড়। যেখানে বিষাক্ত পোকা, মাকড়ের সাথে গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল দিনরাত বিষবাষ্প তৈরি করছে। রোগজীবাণুর এসব কারখানা থেকে বিস্তার ঘটছে মারাত্মক রোগ, ব্যাধি। দূষিত হয়ে পড়ছে নগরের সার্বিক পরিবেশ। এসব আবর্জনা স্তূপ গড়ে উঠছে বেশিরভাগ আবাসিক এলাকায়। এক্ষেত্রে এলাকার বাসিন্দাদের অসচেতনতা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কোন অংশেই কম দায়ী না। তবে পৌরসভার লাগসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকলে বিশেষ করে আবর্জনা সংরক্ষণ, ব্যবহার নির্দেশনা থাকলে এবং নাগরিকদের মানার সদিচ্ছা থাকলে এমন দূরাবস্থার সৃষ্টি হবে না।

শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা বংশখালের ভয়াবহ সচিত্র প্রতিবেদন একাধিকবার তুলে ধরেছি। সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের পরামর্শ ও নেতৃত্বে সম্মিলিত উদ্যোগ এবং পৌরসভার মেয়রের ঐকান্তিক লেগে থাকা ও জেলা প্রশাসনের পরিবীক্ষণে গবাখাল ইতিমধ্যে শতভাগ না হলেও আবর্জনামুক্ত হয়েছে। আশা করছি পর্যায়ক্রমে বংশ খাল, বানিয়াবাজার খালসহ জেলার প্রতিটি খাল, বিল, নদী, নালা, জলাশয় দূষণমুক্ত, দখলমুক্ত এবং বর্জ্যমুক্ত হবে।

জামালপুর পৌরসভার কাছারীপাড়া মেষ্টা খানবাড়ি সংলগ্ন উন্মুক্ত স্থানে রাস্তার পাশে মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতিকর ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। ১০ জুন বিকেলের ছবি। ছবি : বাংলারচিঠিডটকম

লক্ষ্য করছি প্রতিদিন জামালপুর শহরে পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ড্রেনগুলো পরিষ্কার করছে। অথচ কিছুদিন যেতে না যেতেই ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বাসা, বাড়ির বর্জ্য, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের, ক্লিনিকের ক্ষতিকারক বর্জ্য ড্রেনে এবং খালগুলোতে ফেলা হচ্ছে। অবিবেচক মানুষগুলোর এহেন আচরণে পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

৫৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জামালপুর পৌর এলাকার কৃষি অধ্যুষিত অঞ্চলই অর্ধেকের বেশি। গৃহস্থালি ও কৃষিজাত বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় একসময় পচে গলে বিষাক্ত হয়ে উঠে। অথচ একটু সচেতন হলেই এসব বর্জ্য জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

সবচেয়ে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো শহর, শহরতলী, গ্রাম পর্যায়েও প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশের জন্য বেশি ঝুঁকি তৈরি করছে। এসব বর্জ্য পচে না গলে না, ধংসও হয় না। পুড়ানো হলেও এর বিষাক্ত ধোয়ায় বায়ুমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পলিথিন মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে দেয়। ফসল উৎপাদনে চরমভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধংস করে ফেলে। অতিমাত্রায় প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহারের ফলে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

২৫/৩০ বছর আগেও আমরা দেখেছি কাগজের ঠোঙ্গা, চটের ব্যাগের প্রচলন ছিল। এর আগে পদ্ম পাতা, কলা পাতার ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল। এসব ব্যবহার্য পণ্য মাটি, বায়ু ও পানি দূষণের সৃষ্টি করতো না। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কোন সম্ভাবনা ছিলো না।

সদর আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ নির্বাচিত হবার পর থেকেই ‘গ্রিন জামালপুর, ক্লিন জামালপুর’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তিনি নিরন্তর পরিশ্রমও করছেন। নিজ হাতে কাজ করে দেখাচ্ছেন।

শহর জুড়ে আবর্জনার স্তূপ এবং রাস্তা, ঘাটে অসহনীয় ধুলোবালির সাথে যত্রতত্র ময়লার জট অপসারণ না করা গেলে গৃহীত কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

পূর্বের মেয়রের আমলে প্রতিদিন শহরে তিনশ পরিচ্ছন্ন কর্মীর বিল করা হতো। বাস্তবে ৩০ জনও দেখা যায়নি বলে কোন এক সংসদ সদস্য জেলা পর্যায়ের এক সভায় ক্ষোভের সাথে প্রকাশ করেছিলেন। এখন কতজন পরিচ্ছন্ন কর্মী আছে জানা নাই। ইদানিং অবশ্য প্রতিদিন শহরের কোন না কোন ড্রেন পরিষ্কার করতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ময়লার ভাগাড়গুলো রহস্যজনক কারণে ধংস হচ্ছে না কেনো এ প্রশ্ন আজ সুধী সমাজের।

আমার মতে মেয়র মহোদয়কে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে ভিতরে এবং বাইরে। তার কর্মীদের যেমন নজরদারীর মধ্যে আনতে হবে তেমনি আইন বা পৌর বিধি লঙ্ঘন করে যেখানে সেখানে ময়লা ফেললে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। এর আগে বাড়ি বাড়ি টাকার বিনিময়ে ময়লা রাখার ঝুড়ি সরবরাহ করতে হবে। রাত ১০টার পর অথবা ভোর বেলায় বাড়ির সামনে ময়লার ঝুড়ি রেখে দিতে হবে। পৌরসভা থেকে ভ্যান অথবা ময়লার গাড়ি ভোর ৬টার মধ্যে ময়লাগুলো তুলে নিয়ে ডাম্পিং স্টেশনে ফেলে আসবে। এ কাজ তদারকির জন্য মহল্লায় মহল্লায় একটি করে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক কমিটি গঠন করতে হবে। এরা সবসময় নজর রাখবেন।

প্রত্যেক বাড়ির মালিক ময়লা বাবদ ১০০/- টাকা অথবা পৌরসভার নির্ধারিত মাসিক টাকা রশিদের মাধ্যমে পরিশোধ করবেন।

নগর পিতা হিসেবে মেয়র মহোদয় নিজে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম সরাসরি অথবা অনলাইনের মাধ্যমে তদারকী করবেন। কাউন্সিলরগণ মেয়রের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবেন। মেয়রের কাছে নিয়মিত জবাবদিহি করতে হবে লিখিতভাবে। পৌরসভায় কেন্দ্রিয়ভাবে একটা পরিবীক্ষণ দল গঠন করা থাকবে। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ পর্যবেক্ষণ করবেন। মাসে কমপক্ষে একটি হলেও এই কমিটি সভা করে কাজে অগ্রগতি দেখবে।

আসলে বর্জ্য অপসারণের জন্য সবার সদিচ্ছা, আন্তরিকতার বিকল্প নাই। জনসচেতনতাই গণজাগরণ তৈরি করতে পারে। এ কাজে ঘোষণা দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এমন তাড়না তৈরি করতে হবে যাতে করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠে।

লেখক: সভাপতি, জামালপুর পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন ও উন্নয়নকর্মী।