জামালপুরে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি : নাগরিকদের করণীয়

জাহাঙ্গীর সেলিম ::

বিশ্বব্যাপী আজ পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য চরম ঝুঁকির মধ্যে আছে। ভোগবাদী জীবনাচরণ স্বার্থান্ধ ও লোভী মানুষের আগ্রাসনের ফলে পৃথিবী নামের সুন্দর গ্রহটি আজ গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ থেকে শুরু করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাবিরোধী ক্ষতিকারণ গ্যাস ও পদার্থ বায়ুমন্ডলকে উষ্ণ করে তুলছে। বিশেষ করে অভাবনীয় পর্যায়ে যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার, রাসায়নিক ও নিয়ন্ত্রণহীন কারখানা, যানবাহনের দানবীয় চলাচল সভ্য দুনিয়াটাকে ক্রমশই মানুষের বাস অনোপযোগী করে তুলছে। যাই হোক আজ আমি ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাইতে চাই না। আজ আমার আলোচনা বিষয় শুধুমাত্র জামালপুর।

যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত, গারো পাহাড় ও মধুপুর গড় বেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের জামালপুর। হযরত শাহজামাল (রহ.) ও হযরত শাহ কামাল (রহ.) এর পুণ্যভূমিখ্যাত জামালপুর ইতিহাস, ঐতিহ্যে দেশের যেকোনো জেলার চেয়ে সমৃদ্ধ এক জনপদ। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে ফকির মজনু শাহ থেকে শুরু করে সুভাস বসু, শেরে বাংলা, মৌলানা ভাসানীসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পদচারণায় ধন্য জামালপুরের মাটি বার বার সংগ্রামের ঘাটি হিসেবে প্রমাণ দিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে জামালপুরের অগ্নিগর্ভ দিনগুলো স্বাধীনতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।

জামালপুর পশ্চাৎপদ ছিল না একসময়। ‘ধন, ধান্যে, পুষ্পেভরা’ ছিল গোটা অঞ্চল। নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর, দিঘিসহ নানা ধরনের জলাশয়ে ছিলো পূর্ণ। ৭০/৭৫ বছর আগেও জামালপুরে বনাঞ্চল ছিল মোট স্থল ভূমির প্রায় ২৫ ভাগ। প্রত্যেক বাড়ির পেছনেই ছিল আরা বা জঙ্গলাকীর্ণ। মাছে, ভাতে বাঙালি এটা আজ প্রবাদ মনে হলেও একসময় ছিল বাস্তবতা। নানা ধরনের, বর্ণের পশু, পাখি, গাছ, পালা, পোকা, মাকড়ের অবাধ বিচরণ ছিল।

জমিতে কখনোই রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার হতো না। কলের লাঙ্গল, গভীর নলকূপের ভয়াবহ তান্ডব ছিল না। পরিবেশবিদদের মতে কলের লাঙ্গল এবং যন্ত্র বা ইঞ্জিন চালিত নৌকা থেকে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল মাটি এবং পানিতে নির্গত হচ্ছে তাতে করে মাছশুন্য হয়ে পড়েছে আমাদের নদী ও জলাশয়গুলো। পাশাপাশি মাটি থেকে বিলুপ্তপ্রায় উপকারী জীব ও উদ্ভিদ। একবার যে মাটিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় ১৫ বছর ধরে তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া চলে। আমরা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অধিকমাত্রায় ওইসব ব্যবহার করায় মাটিকে ক্রমশই তামায় পরিণত করছি।

এখন কোন বাড়িতেই গোয়ালভরা গরু নেই। গ্রামেও গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করায় ছাই দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। অথচ ছাই এবং গোবর ছিল কৃষি উৎপাদনের প্রধান সার। কালের আবর্তে পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত আধুনিক পদ্ধতির নামে ধংস করা হয়েছে আমাদের হাজার বছরের কৃষি সংস্কৃতি। এসব সারাদেশেরই চিত্র।

জামালপুরের পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি নিয়ে কথা বলতে চাই। জামালপুরের নগর সভ্যতা গড়ে উঠা এবং জীবিকায়নের প্রধান উৎস ব্রহ্মপুত্র নদকে মেরে ফেলার সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। দুই পাড়ের প্রায় ২০ কিলোমিটার দখল করেছে নদীখেকো দানবরা। ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের ধূসর শরীর। উজানে বাঁধ দিয়ে নদের গতিপথকেই পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মাঝ নদের কোন কোন জায়গা দখল করে ভরাট করা হয়েছে। দখল চলছে অবাধে। সব ধরনের বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে ব্রহ্মপুত্রকে।

প্রমত্তা হারিয়েছে তার রূপ লাবন্য। যমুনা ব্রিজ নির্মাণের পর থেকে নদী যেনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। দখল হয়েছে বিস্তৃত নদী এলাকা। শান্ত ও স্রোতস্বিনি ঝিনাই নদীকে তিলে তিলে মেরে ফেলা হচ্ছে। বংশাই, সুবর্ণখালি, ঝাড়কাটা, দশানিসহ জালের মতো নদী, শাখা নদী আজ বিলুপ্তের পথে।

তথ্যমতে জমালপুর জেলার কমপক্ষে ৭০০ হেক্টর বিল ও জলাশয় ভরাট করে দখলে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। অসমর্থিত সূত্রে অর্ধশতাধিক খাল ধংসের শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জামালপুর পৌরসভা এলাকায় এ পর্যন্ত শতাধিক পুকুর ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

গত এক দশকে রাস্তা নির্মাণ, নগর সম্প্রসারণ, স্থাপনা নির্মাণের নামে দুই লক্ষাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বর্তমান জেলায় মোট স্থলভূমির ১০ ভাগ গাছও নেই। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কমপক্ষে ২৭ ভাগ গাছ থাকা বাঞ্ছনীয়।

জামালপুর বকশীগঞ্জ লাউচাপড়া পাহাড় কেটে ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে। নুড়ি পাথর আহরণের নামে পাহাড় কেটে ধংস করা হচ্ছে। এছাড়া দেওয়ানগঞ্জ এলাকা, সদরের শ্রীপুর, শরিফপুর, শাহবাজপুর, বাঁশচড়া এলাকার প্রচুর বনভূমি সাবাড় করা হয়েছে। যত্রতত্র বিনা নিবন্ধনে ইটের ভাটা নির্মাণ করে এবং কাঠ পুড়িয়ে পরিবেশের ১২টা বাজানো হচ্ছে। দুই শাতাধিক ইটের ভাটা থাকলেও সরকারি নিবন্ধন আছে মাত্র ৫/৭টি।

যেখানে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে কাঠফাড়া বা করাত মিল। সরকারি অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের নাকের ডগায় স্থাপিত আছে করাত কল।

আরসিসি ঢালাই করা সড়ক নির্মাণ কতটা পরিবেশসম্মত তা পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এখন নিরব থাকলেও আগামীদিনে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মানুষ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি অনিবার্য হয়ে উঠবে বলে অনেকেই মত ব্যক্ত করছেন।

জামালপুরে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন বিশেষ করে ভটভটি মার্কা গাড়িগুলো শুধু শব্দ দূষণই করছে না বায়ু দূষণেরও অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শব্দ দূষণ করছে ইট ভাঙা মেশিন, ডিজে পার্টির বিকট আওয়াজ, মাইকিংয়ের নামে কান তালা লাগার মতো শব্দ। প্রতিদিন জামালপুর শহরে যে পরিমান যানবাহন চলাচল করছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পৌরবাসী বাসযোগ্যতা হারাবে।

জামালপুর পৌরশহর থেকে শুরু করে জেলার প্রতিটি পৌর এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার ফলে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করছে।

উল্লেখিত বিষয়ের আলোকে এখনই যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ বা পদক্ষেপ না গ্রহণ করে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে শুধু পরিবেশেরই বিপর্যয় হবে না মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।

আমাদের জামালপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ জামালপুরবাসীকে সাথে নিয়ে সবুজ ও পরিচ্ছন্ন নগর গড়ে তুলতে নতুন এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। ইতিমধ্যে গবাখাল সংস্কার অভিযান শুরু করেছেন। ওষুধিসহ বৃক্ষ রোপণের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ৭০ কিলোমিটার সড়কে গাছ লাগানো হবে। অর্জুন, বহেরা, নিম, বাসক গাছ লাগানো শুরু হয়েছে।

আমরা মাননীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে ২০২৪ সাল থেকেই শুরু করতে চাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্য আনতে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন।

অন্যান্য সংসদ সদস্য থেকে শুরু সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, সরকারি সকল দপ্তর, সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু, নদীখেকোসহ দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।

‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে’ এ তাড়না সবাই চিন্তা, চেতনা ও মননে ধারণ করে এগিয়ে চললে ব্রহ্মপুত্র ফিরে পাবে তার হারানো যৌবন। যমুনা যত্রতত্র আর ভাঙবে না। ঝিনাইয়ে পাওয়া যাবে আবার রূপালী মাছ। গবাখালে সাতরাবে শিশু, কিশোরের দল। বংশ খাল আশীর্বাদ হয়ে উঠবে শহরবাসীর। শব্দ নিয়ন্ত্রণ করবে গাড়ির ড্রাইভার, যন্ত্র চালকরাই। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বদলে কৃষকরা জৈব সার তৈরিতে প্রতিযোগিতা শুরু করবে। পরিবেশ রক্ষার যুদ্ধে জয় আমাদের হবেই ইনশাল্লাহ।

লেখক: সভাপতি, জামালপুর পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন এবং উন্নয়নকর্মী