ঝুঁকিপূর্ণ দেওয়ানগঞ্জ-ডাংধরা সড়ক যেন পাঁচ লাখ মানুষের কষ্ট

রাস্তা নয়, যেন মরণফাঁদ। ছবিটি দেওয়ানগঞ্জ-ডাংধরা সড়কের হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নের সাপমারি এলাকা থেকে তোলা। ছবি : বাংলার চিঠি ডটকম

নিজস্ব প্রতিবেদক, জামালপুর॥
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দেওয়ানগঞ্জ-তারাটিয়া বাজার-ডাংধরা সড়কটি তিন বছর ধরে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। সড়কটির বিভিন্ন স্থানে কার্পেটিং ওঠে ছোটবড় দুই শতাধিক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা ও বকশীগঞ্জ উপজেলার আংশিক এবং পাশের কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলাসহ প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের কষ্ট আর কান্নায় পরিণত হয়েছে সড়কটি। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে চরম অচলাবস্থাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নয়ন কাজে পিছিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। প্রশস্তকরণসহ সড়কটি নতুন করে নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

জানা গেছে, ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের পাররাম রামপুর ইউনিয়নের তারাটিয়া বাজার থেকে দেওয়ানগঞ্জ সদর পর্যন্ত প্রায় ২১ কিলোমিটার সড়কে সবচেয়ে বেশি ভাঙা ও গর্ত হয়ে গেছে। উপজেলার সীমান্তবর্তী ডাংধরা ইউনিয়নের কদমতলি বাজার থেকে তারাটিয়া বাজার পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার সড়কেরও বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা সদরের সাথে ওই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের এটিই একমাত্র সড়ক। এর কোনো বাইপাস সড়কও নেই।

এ সড়কে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সড়কটিকে কেন্দ্র করে প্রাচীন সানন্দবাড়ী বাজার, তারাটিয়া বাজার, ঝালরচর বাজার ও বাহাদুরাবাদ বাজার বেশ প্রসিদ্ধ। কিন্তু সড়কের বেহালদশার কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও জামালপুর সদর থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান সরাসরি ব্যবসায়ীদের আড়তে বা দোকানে পৌঁছে দিতে পারছে না। পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহনগুলো জামালপুর-শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার ঝগড়ার চর-ইসলামপুরের ব্রহ্মপুত্র সেতু হয়ে দেওয়ানগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করতে পারে। যানবাহন উত্তরাঞ্চলের চারটি ইউনিয়নে যেতে জামালপুর- শেরপুর-বকশীগঞ্জ হয়ে চলাচল করতে হয়। ফলে পরিবহন খরচ ও সময় দুটোই লাগছে দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যদিকে পাশের জেলা কুড়িগ্রামের চিলমারী, রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলার লোকজন এই সড়কে দেওয়ানগঞ্জে গিয়ে ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করতো। কিন্তু তারা এখন ঝুঁকি এড়াতে সরাসরি বকশীগঞ্জ-শেরপুর সড়কে যাতায়াত করে থাকে।

পরিবহন খরচ বেশি পড়ায় উপজেলার উত্তরাঞ্চলের চারটি ইউনিয়নের ধান, পাট, ভুট্টা থেকে শুরু করে সকল কৃষিপণ্য নিয়ে বিপাকে রয়েছেন কৃষকরা। বকশীগঞ্জ ঘুরে ঢাকায় পণ্য পরিবহনে প্রতি কেজি পণ্যে অস্বাভাবিক বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে দু’য়েকটা ইজিবাইক ও সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করলেও গর্তের মধ্যে আটকা পড়ে। ঠ্যালা-ধাক্কা দিয়ে তুলতে হয়। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নের কাঠারবিল এলাকায় মহারানী সেতুটিও ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে নড়বড়ে, অন্যদিকে সেতুর মাঝখানে ভেঙে বড় গর্ত হয়েছে। সেতুটি যেকোনো মুহূর্তে ধসে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় কৃষক সাদার আলী (৫৫) বললেন, ‘এই সেতুতে একটি রিকশা উঠলেও গর্তে আটকা পড়ে। রাস্তা ভাঙা থাকলেও কিছু গাড়ি চলতো। কিন্তু এই সেতুটার কারণেই গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।’

বৃষ্টি হলে দেওয়ানগঞ্জ-ডাংধরা সড়ক যেন ডোবা বা খালে পরিণত হয়। ছবিটি এই সড়কের ঝালরচর বাজারের। ছবি : বাংলার চিঠি ডটকম

সেতুটির কাছাকাছি সাপমারী এলাকায় বেশ বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের নিচে যেন একটা বিশাল চোরাগুপ্তা সুড়ঙের সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে সড়ক ধসে পড়তে পারে। স্থানীয় কৃষক সাহেবুর রহমান (৬২) বললেন, ‘এইখানে রাস্তার নিচ দিয়া মেলা বড় গাতা অইছে। কহন যে কি অয়। ভয়ে আমরাই মাইনসেরে এই রাস্তায় গাড়ি চালাবের না করি।’

পাররাম রামপুর ইউনিয়নের ডিগ্রিরচরের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুল আলিম বললেন, ‘দেওয়ানগঞ্জে যেতে রাস্তা অনেক জায়গায় ভাঙা। অনেক সময় গাড়ি উল্টে মানুষ আহত হয়, কয়েকজন মারাও গেছে। রোগী নিয়ে দেওয়ানগঞ্জ হাসপাতালের দিকে রওনা হলে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়। গর্ভবতী বা অন্যান্য জটিল রোগীদের দেওয়ানগঞ্জ হাসাপাতালে না নিয়ে বেশিরভাগ রোগীকে পাশের বকশীগঞ্জ বা শেরপুর জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ অঞ্চলের রোগীদের নিয়ে জামালপুরে যেতে পারে না। ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজে যেতে খুবই সমস্যা হয়। সামান্য সাইকেলে রওনা দিলেও অনেকবার নামতে হয়। সড়কটির কারণে এ অঞ্চলের সবাই চরম দুর্ভোগে আছি। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

পাররাম রামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী জুয়েল বাংলার চিঠি ডটকমকে বলেন, ‘সড়কটির বেহালদশার কারণে পাররাম রামপুর, ডাংধরা এবং চর আমখাওয়া ইউনিয়নের লোকজন নিতান্তই দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশনে এবং উপজেলা পরিষদে দাপ্তরিক কাজ ছাড়া যায় না। চিকিৎসা ও কেনাকাটাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ পাশের বকশীগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে করতেছি। বিকল্প পথে বাড়তি খরচের কারণে কৃষি প্রধান এই এলাকার কৃষকরা কৃষিপণ্যও বিক্রি করতে পারছে না। সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি। বর্তমান সরকারের মেয়াদও প্রায় শেষের দিকে। আদৌ সড়কটি নির্মাণ হবে কিনা তা নিয়েও আমরা সন্দিহান।’

দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বেহাল সড়ক প্রসঙ্গে বাংলার চিঠি ডটকমকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় কমিটির সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সড়কটি প্রশস্তকরণসহ নতুন করে নির্মাণের জন্য এলজিইডিকে প্রকল্প তৈরি করতে বলেছি।’

জামালপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বাংলার চিঠি ডটকমকে বলেন, ‘দেওয়ানগঞ্জ-ডাংধরা রাস্তাটিকে বন্যাপুনর্বাসন প্রকল্পভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রাস্তাটির দেওয়ানগঞ্জ থেকে তারাটিয়া বাজার পর্যন্ত মোট ২১ কিলোমিটার প্রশস্তকরণসহ নির্মাণ করা হবে। এর জন্য দু’টি আলাদা প্রাক্কলন তৈরি করছি। শিগগির তা এলজিইডির সদর দপ্তরে পাঠানো হবে।’